# আরাফাত হোসেন, বিনোদপুর শিবগঞ্জ থেকে……………………
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শিবগঞ্জ উপজেলা বাংলাদেশের আমের রাজধানী হিসাবেই খ্যাত।আম বাংলাদেশের প্রধান ফল, গ্রীষ্ম প্রধান দেশে ফলের মধ্যে আম সবার সেরা, ফলের রাজা। নানা আকারের বাহারি আম অতি সুস্বাদু ও পুষ্টিতে ভরপুর। আমে রয়েছে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে এতে ভিটামিনস ও মিনারেলসের পরিমাণ অনেক বেশি। এককালে বৃহত্তর রাজশাহী, জেলা উন্নতমানের আমের জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব এলাকা প্রধানত ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ফজলি, হিমসাগর, মোহনভোগ, গোলাপ খাস, সূর্যপুরি, মিসরি ভোগ, আশ্বিনাসহ প্রায় কয়েক শ’ জাতের আম উৎপাদনে অগ্রগামী ।
দেশের অন্য প্রান্তের জনসাধারণ মধুর মাস জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণে রাজশাহী অঞ্চলের সেরা আমের জন্য অপেক্ষা করে। বাংলাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৌরমতি, বারি উদ্ভাবিত বারি-৪, বাউ উদ্ভাবিত বাউ-১৪ (ব্যানানা ম্যাংগো), ‘রাংগুয়াই’ (বার্মা), পলিমার (ভারত), নান ডকমাই (থাই) অন্যতম। শিবগঞ্জ উপজেলা বিভিন্ন এলাকা সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আমের সংরক্ষণ রোগ প্রতিরোধ, সহ পোকা থেকে রক্ষা করার জন্য আমে প্যাকেট করা শুরু হয়েছে। এই আম প্যাকেটের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহাবাজপুর ইউপি তেলকুপি বিশ্বাসটোলা গ্রামের বিশিষ্ট আম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মোঃ শামীম হোসেন ,বাইজুল ইসলাম (ডাক্কু), মোঃ ফটিক সহ মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, আম প্যাকেট করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই ঝড়ো মৌসুমে ঝড়ো আবহার ভিতর আম ঝরে যাওয়া থেকে রক্ষা পোকা, রোগ, জীবাণু, থেকে মুক্ত রাখা ও আমের গুণগত মান ঠিক রাখা যায়।
আম ফল চাষে অগ্রগামী জেলা বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মৌসুমে ৩-৪ মাসব্যাপী আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণসহ সংশ্লিষ্ট কাজে সব শ্রেণী ও বয়সের ছেলেমেয়ে, পুরুষ, মহিলা প্রচুর কাজের সুযোগ পায়, আয় বাড়ে, পারিবারিক সচ্ছলতা আসে। স্থানীয় পরিবহন (রিকশা, বাইসাইকেল, অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, মিনিট্রাক-পিকআপ) খাতে আয় বৃদ্ধিসহ সংশ্লিষ্ট সবার যথেষ্ট আয় বাড়ে। এ ছাড়া আন্তঃজেলা পরিবহনে (বাস, ট্রাক, ট্রেন, ট্রলার, কুরিয়ার সার্ভিস) সঙ্গে জড়িত সবার প্রচুর আয় বৃদ্ধি পায় ।
আম উৎপাদনকারী এসব এলাকা ঝড় বাতাসে ঝরে পড়া কাঁচা-পাকা আম খাওয়ার প্রচুর সুযোগ পায়। এ সময় বেশি আম খাওয়ার প্রভাবে সবার স্বাস্থ্য ভালো হয়, দৈনন্দিন ভাত আহার করার প্রবণতা অনেক কমে যায়। মৌমাছির আনাগোনা বেড়ে যায়, এ সময় তাদের বেশি মধু আহরণ সুযোগ সৃষ্টি হয় আম মৌসুমে এলাকায় হরেক রকম পাখির (বাদুড়, কাক, কোকিল, ঘুঘু ইত্যাদি) আনাগোনা বেড়ে যায়। এ সময় তাদের খাদ্য, আশ্রয় ও বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এছাড়াও বন্য ও গৃহপালিত পশুদের কাঁচা-পাকা আম ও পরিত্যক্ত অংশ (ছিলকা, আঁটি) খাবার সুযোগ বাড়ে, ফলে সবাই সুস্বাস্থ্য ফিরে পায়।
কাঁচা-পাকা আম থেকে আমচুর, আমসত্ত্বসহ নানা রকম আচার তৈরির কাজে এলাকায় হিড়িক পড়ে যায়। রান্নায় প্রাধান্য পায় আম-বেগুন-বড়ির তৈরি তরকারি, ডালে আম, সজিনায় আম এ এক মধুর ব্যাঞ্জন। স্থানীয়ভাবে তৈরি আমের জ্যাম, জেলি এলাকাবাসী নিজেরা খায়, অন্য জেলার আত্মীয়স্বজনকে সরবরাহ করে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান (প্রাণ, এসিআই, স্কয়ার) কাঁচা-পাকা আম সংগ্রহ করে। এগুলো তারা প্রক্রিয়াজাত করে উৎপাদিত হরেক রকম প্রডাক্টস সারা বছরব্যাপী দেশে-বিদেশে বাজারজাত করে প্রচুর আয় করে।
আম বাজারজাতকরণ পরিস্থিতি ও প্রভাব : এককালে আম চাষে অগ্রগামী বৃহত্তর রাজশাহীর আমচাষিরা বড় বড় বজরা-নৌকা দিয়ে ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে আম বাজারজাত করত। পরে সহজ এ রুট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ট্রাক, বাস, ট্রেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আম বাজারজাতকরণের বিকল্প পরিবহন ব্যবহার হয়ে আসছে। আমচাষিদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ বছর আগে কোনো রকম কেমিক্যাল ব্যবহার ছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পরিপক্ব কাঁচা আম বাজারজাত করার প্রচলন ছিল। পাকা আমের সেলফ লাইফ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীদের পক্ষে তা দূর-দূরান্তে বেচার সুযোগ থাকে না।
কাজেই স্থানীয়ভাবে খুব কম দামে স্থানীয় এলাকাবাসী পাকা আম কেনার সুযোগ পান। বিগত ৫ থেকে ৭ বছর ধরে আম ব্যবসায়ীদের মাঝে ঢাকাসহ অন্য জেলাগুলোতে আম বাজারজাত করতে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে। আমকে সমভাবে পাকাতে ও আকর্ষণীয় রঙ হতে ও কিছুটা আয়ু (সেলফ লাইফ) বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কিছু আম ব্যবসায়ীর আমে কয়েক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ইথোফেন, ফরমালিন ও কার্বাইড অন্যতম। আম ফলে এসব রাসায়নিকের প্রভাব সম্বন্ধে কোনো প্রকার জ্ঞান বা ধারণা আহরণ না করেই অনেক পরিবেশবাদী, বুদ্ধিজীবী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিভিন্ন মিডিয়া কেমিক্যাল ব্যবহারের কুফল সম্বন্ধে অপপ্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ প্রচারণার কুফলে আম ফলের প্রতি অনুরাগী ভোক্তার মনে ভয় ঢুকেছে, বাজারের আম কিনতে তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
এ পরিস্থিতিতে আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের টিকে থাকাই বর্তমানে কঠিন হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর রাজশাহীসহ অন্য অধিক আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে মুকুল আসার শুরুতে এমনকি তার অনেক আগেই ২ থেকে ৫ বছরের জন্য আম বাগান কিনে নিতে প্রয়াসী ছিল। এ ব্যবস্থায় আমচাষিদের বাগান অনেক আগেই কিনে নিতো। বেশি লাভের আশায় তারা কেনা বাগানের সঠিক পরিচর্যা ও রোগ পোকামাকড় দমন করে বেশি আম উৎপাদন পদক্ষেপ নিতো। তাতে বাগানের মালিক ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে বেশি লাভবান হতো
আম শোধনে রাসায়নিক ব্যবহার : গাছ থেকে আম পাড়ার পর আমের কস বা দুধ বের হয়ে গেলে আম শোধন উপযোগী হবে। প্রতি লিটার পানিতে ০.৫৫ মি.লি. ‘প্লোক্লোরাজ’ নামক রাসায়নিক দ্রব্য মিশানো পানিতে আম ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এভাবে আম শোধনে আমের পচন রোধ হয় ও উজ্জ্বলতা বজায় থাকে। অধিকন্তু, আম পাড়া থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত আমের জীবনী (সেলফ লাইফ) ২-৩ সপ্তাহ বজায় থাকে। আম রপ্তানিকারক সব দেশেই এ পদ্ধতির ব্যবহার প্রচলন আছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫-১.০০ গ্রাম ‘বেনোমিল’ নামক রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে তাতে একইভাবে আম শোধন করা যাবে। এ পদ্ধতিতে আম শোধন ব্যবস্থা ভারতে অতি জনপ্রিয়। অধুনা, কিছু সচেতন আমচাষি ভারত থেকে ‘বেনোমিল’ এনে আম শোধন করে সুফল পেয়ে আসছে।
গরম পানিতে পরিপক্ব কাঁচা আম শোধন করা হলে, আমের গায়ে লেগে থাকা রোগ জীবাণু ও পোকা মুক্ত হবে। গ্রাহকের কাছে অন্য আমের তুলনায় এ শোধিত আমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে। মৌসুমে পরিপক্ব পুষ্ট কাঁচা আম গাছ থেকে সাবধানে পেড়ে তা আগে পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর কোন পাত্রে ৫২০- ৫৫০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি (পানিতে হাত ডুবালে সহনীয়মাত্রায়) গরম হলে তাতে পরিষ্কার করা আমগুলো ঠিক ৫ মিনিট রেখে এক সাথে উঠিয়ে নিতে হবে। আমের গা থেকে পানি শুকিয়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মে আমগুলো প্যাকিং করে বাজারজাত করতে হবে। #
এডিট: আরজা