আবুল কালাম আজাদ, বিশেষ প্রতিনিধি………………………………………..
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ যেমন বাড়ছে, তেমনি এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আদায় অযোগ্য কুঋণ বা মন্দ ঋণ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৮৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাকি মাত্র ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ অন্যান্য শ্রেণির খেলাপি ঋণ। এর মধ্যে নিম্নমান বা নতুন করে খেলাপি হয়েছে-এমন ঋণ ৭ শতাংশ ও এক বছরের কম সময় ধরে খেলাপি-এমন ঋণ ৫ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের সিংহভাগই আদায় অযোগ্য মন্দা ঋণ। ওইসব ঋণ আদায় না হওয়ার রীতিমতো ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে পুরো ব্যাংক খাত। এর দায় এসে পড়ছে আমানতকারী, ঋণগ্রহীতা ও শেয়ারহোল্ডারদের ওপর।
ব্যাংকিং পরিভাষায় এসব ঋণ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন জমা রাখতে হয়। ফলে যে পরিমাণ ঋণ মন্দ হিসাবে শ্রেণিকৃত হবে, ওই পরিমাণ প্রভিশন রাখতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এতে মন্দ ঋণের বিপরীতে দ্বিগুণ অর্থ আটকে থাকে। মন্দ ঋণ হিসাবে আটকে আছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন হিসাবে আটকে রয়েছে সমপরিমাণ অর্থ। এ দুটি মিলে মোট ২ লাখ ৭২ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এর মধ্যে ঋণ বাবদ আটকে থাকা অর্থ আমানতকারীদের। এর বিপরীতে আমানতকারীদের নিয়মিত মুনাফা দিতে হচ্ছে। প্রভিশন বাবদ আটকে অর্থ ব্যাংকের মুনাফা থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে। এগুলোর ওপর ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের দাবি রয়েছে। প্রভিশন খাতে এসব অর্থ আটকে না থাকলে শেয়ারহোল্ডাররা বাড়তি ভল্যাংশ পেতেন। কিন্তু মন্দ ঋণের কবলে পড়ে তাদের লভ্যাংশ কমেছে।
মন্দ ঋণের বিপরীতে আটকে থাকা পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকার বিপরীতে কোনো আয় হচ্ছে না ব্যাংকের। উলটো আমানতকারীদের মুনাফা দেওয়া, ঋণের ব্যবস্থাপনা, বন্ধকী সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে ব্যাংকের বাড়তি অর্থ খরচ হচ্ছে। বেশিরভাগ মন্দ ঋণের বিপরীতে মামলা করা রয়েছে। ওইসব মামলা পরিচালনায়ও অর্থ খরচ হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ৬৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন (অর্থাৎ ব্যাংকের চলমান হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে) করা হয়েছে। এগুলো সবই মন্দ ঋণ হিসাবে শ্রেণিকৃত ছিল। আদায় করতে না পারায় এগুলো মন্দের তালিকায় এসেছে। পরে সেগুলো অবলোপন করা হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতেও শতভাগ প্রভিশন রয়েছে। ফলে এ খাতেও আটকে রয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। এ খাতেও মন্দ ঋণের মতো অর্থ খরচ হচ্ছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খেলাপির বিরুদ্ধে মামলা করে ঋণ অবলোপন করতে হয়। এর বিপরীতে অর্থ খরচ হচ্ছে। চলমান মন্দ ঋণ ও অবলোপন মিলে আটকে রয়েছে ৪ লাখ ৩ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কিস্তি পরিশোধ না হলে এর ৬ থেকে ৯ মাস পর ঋণটি নিম্নমানের খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। ৯ মাস থেকে ১ বছর পর সন্দেহজনক হিসাবে ও ১ বছর ৩ মাস থেকে দেড় বছরের মধ্যে কিস্তি পরিশোধিত না হলে তা মন্দ বা আদায় অযোগ্য ঋণ হিসাবে চিহ্নিত হবে। অর্থাৎ কোনো ঋণ ১ বছর ৩ মাস থেকে দেড় বছর আদায় না হলে তা নিম্নমান হিসাবে চিহ্নিত হয়। ওই সময় ধরে আদায় হয় না-এমন ঋণই এখন ব্যাংক খাতে মোট খেলাপির প্রায় ৮৮ শতাংশ। নতুন খেলাপি মাত্র ৭ শতাংশ। সন্দেহজনক মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণ খেলাপি হলে তা বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে মন্দের খাতায় নাম লেখায়। এভাবে আদায় অযোগ্য ঋণ বেড়েই চলেছে।
২০১৯ সালে ব্যাংক খাতে আদায় অযোগ্য ঋণ ছিল ৮১ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। যা ওই সময়ে মোট খেলাপির ৮৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০২০ সালে তা সামান্য কমে ৭৬ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা হয়। তবে শতকরা হিসাবে এ ঋণ বেড়ে যায়। ওই সময়ে মোট খেলাপির ৮৬ দশমিক ৯০ শতাংশ ছিল মন্দ ঋণ। যা আগের চেয়ে ১ শতাংশ বেশি।
২০২১ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯১ হাজার ৬০ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। ২০২২ সালে মন্দ ঋণের পরিমাণ প্রথম বারের মতো লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে। ওই বছরে মন্দ ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার ৯৮২ কোটি টাকায়। যা ছিল মোট খেলাপির ৮৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এরপর থেকে মন্দ ঋণের বোঝা আর কমছে না, বেড়েই চলেছে।
২০১৯ সালে খেলাপি ঋণ প্রথম লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে। এরপর আবার কমে লাখের নীচে নামে। কিন্তু ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ আবার লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে। এরপর আর কমছে না, বেড়েই চলেছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মন্দ ঋণ সরকারি ব্যাংকগুলোতেই সবচেয়ে বেশি। চারটি সরকারি ব্যাংকে এ ঋণ বেড়ে সেপ্টেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ১২৫ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে একটি সরকারি ব্যাংকে ১৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা, অপর আরও একটি সরকারি ব্যাংকে ১৫ হাজার ৭২ কোটি টাকা ও আরেকটি সরকারি ব্যাংকে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে মন্দ ঋণ ৬৭ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৪৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকে ২ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকে ৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। যা মোট খেলাপির ২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আগে নিম্নমান ও সন্দেহজনক ঋণ থাকত মোট খেলাপির ১০ থেকে ১৯ শতাংশ। সন্দেহজনক থাকত মোট খেলাপির ৮ থেকে ১৪ শতাংশ। মন্দ ঋণ থাকত ৭০ থেকে ৭৮ শতাংশ। এখন মন্দ ঋণ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮৮ শতাংশ। নতুন ঋণ ৫ থেকে ৭ শতাংশ ও সন্দেহজনক ঋণ ৪ থেকে ৬ শতাংশ। মন্দ ঋণ ২০১৫ সালে প্রথম ৮০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এরপর থেকে আর নামছে না। বেড়েই চলেছে।#