মুনীর চৌধুরী সোহেল
দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর হলো খুলনা অঞ্চলের ৯টি পাটকলসহ সারাদেশের ২৬টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাটকল চালু ও আধুনিকায়ন করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও সেটা পরবর্তীতে আর কার্যকর হয় নি। কার্যকর হচ্ছে, লিজ বা ইজারা’র মাধ্যমে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করা। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে ধ্বংস হচ্ছে শিল্প কলকারখানা। ধূসর প্রান্তরে পরিণত হচ্ছে শিল্পাঞ্চল। এই ধূসর প্রান্তরের মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন বন্ধকৃত খালিশপুর ও দৌলতপুরসহ ৫টি পাটকলের শ্রমিকরা। কারণ তারা এখনো বকেয়া পাওনার ১টি টাকাও পান নি। অথচ দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর দৃষ্টি গেছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার স্থাপনা ও সম্পদের ওপর।
এই ধ্বংসযজ্ঞের হোতা দেশীয় শাসকগোষ্ঠী উন্নয়নের গণতন্ত্রের কথা বলে মেগা-মেগা প্রকল্প হাজির করে, মেগা-মেগা লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করার ব্যবস্থাও করে। এই রাষ্ট্রীয় লুটপাটতন্ত্র চলমান থাকায় শ্রমিকসহ নিরন্ন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। পাটকল বন্ধ হয় ২০২০ সালের ২জুলাই। পাটকলগুলো পুনরায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চালুর দাবিতে সে সময় খুলনার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক নেতৃবৃন্দ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত ‘পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদ’ আন্দোলনে নামে। নাগরিক পরিষদ আহূত আন্দোলনের ১ বছর পর থেকে ‘খালিশপুর-দৌলতপুর জুট মিল যৌথ কারখানা কমিটি’ নামে একটি শ্রমিক সংগঠন প্রায় সাড়ে ৪ বছর আন্দোলন করে আসছে।
আন্দোলনের চাপে ইতোমধ্যে বন্ধকৃত ২০টি পাটকলের স্থায়ী ও বদলী শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অর্ধেক বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি অর্ধেক বেতন সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা করে লাভের অংশ পরিশোধের অঙ্গীকার করেছিলো বিগত সরকার। তবে এ সমস্ত শ্রমিকরা নানা জটিলতার কারণে সম্পূর্ণ বকেয়া বেতন এখনো পাননি।
খুলনার প্লাটিনাম, স্টার, ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ণ, যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিলের শ্রমিকরা বকেয়া মজুরী ও সরকারী সুযোগ-সুবিধা পেলেও খুলনার খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিল, চট্টগ্রামের কেএফডি জুট মিল ও আর আর জুট মিলের শ্রমিকদের একটি টাকাও প্রদান করা হয় নি। ফলে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বিগত ২০২০ সালের ২জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একযোগে ২৬টি পাটকল বন্ধ ঘোষণা করেন।
দুর্নীতি ও লুটপাটের অংশ হিসেবে ২৬টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করা হয়। তখন তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২ মাসের মধ্যে শ্রমিকদের সম্পূর্ণ বকেয়া পরিশোধ ও ৩ মাসের মধ্যে পাটকল চালু করবেন। কিন্তু তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। পাটকল বন্ধ ঘোষণার সময় তিনি মায়াকান্না কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি এই পাটকলগুলো বন্ধ করতে চাইনি’। রাষ্ট্রীয় পাটকল চালু করেছেন লিজ এর মাধ্যমে, ব্যক্তি মালিকানায়। পাটকল শ্রমিকরা এই প্রক্রিয়ার ঘোরবিরোধী।
লিজের মাধ্যমে পাটকল চালু করলে পাটকল লাভে যাবে না, শ্রমিকরাও সম্মানজনক বেতন পাবেন না। কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কায়েমী স্বার্থে, লুটপাটের জন্য। বিগত সরকারগুলোর শাসনামলে যেসকল রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করে ব্যক্তি মালিকানায় দেয়া হয়েছে সেগুলো লাভের মুখ দেখেনি, বরং অধিক হারে দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে, একপর্যায়ে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।খালিশপুর ও আটরা শিল্পাঞ্চলের মহসেন, সোনালী ও এ্যাজাক্স জুট মিল এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
লিজের মাধ্যমে যে পাটকলগুলো চালু করা হয়েছে সেই পাটকল মালিকরা নিয়োগকৃত শ্রমিকদের প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন। অথচ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পাটকল থেকে শ্রমিকরা প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করে পারিশ্রমিক পেতেন। পাট বাংলাদেশের সোনালী আঁশ। এই পাট স্বর্ণের মতোই মূল্যবান। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এই পাটের সুনাম ও ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে, বিভিন্ন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে, আবার ক্ষমতা থেকে বিদায়ও নিয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে পাটকলের আধুনিকীকরণ, পাটকলের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয় নি। বরং দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থে পাটকলসহ বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়।
দুর্নীতি-লুটপাটের জন্য মেগা-মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এই বরাদ্দের সিংহভাগ লুট হয়। পরবর্তীতে নতুন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসলে আবার অর্থ বরাদ্দ হয়, এই বরাদ্দকৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। পাটকল ধ্বংসের মূলে ছিলো বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো। পাটকল বন্ধের সূচনা হয় আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদের আমল থেকে এবং পাটকল নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো আওয়ামী সরকারের আমলে। যে সরকার স্বাধীনতার কথা বলে, স্বাধীনতার চেতনার কথা বলে ।
অথচ এই স্বাধীনতার চেতনার মূলে ছিলো পাট। লুটেরা এই সরকারগুলো লুটের ভাগ পেতে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি’র প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একে একে পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধকৃত এই পাটকলগুলো নিজস্ব রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা এবং দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর কাছে পানির দরে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই নব্য মালিকরাই নতুন করে পাটকল পরিচালনা করতে যেয়ে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, পাটকলে সামান্য অর্থ বিনিয়োগ করে অবশিষ্ট টাকা লোপাট করেছেন। এই লোপাট প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত আছে।
পাটকল বন্ধের ফলে শ্রমিকদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারায়। শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন পথে বসে। শিল্প কল-কারখানা বন্ধের কারণে দেশের সম্পদ ধ্বংস হয়, জনগণের সম্পদ লুট হয়। পাটকল চালুর আশায়, বকেয়া পাওনা পাবার আশায় বুক বেঁধে এখনো যেসব শ্রমিকরা খুলনার শিল্পাঞ্চলে বসবাস করছেন তাদের কাছ থেকে জানা যায়, বর্তমানে জীবনযাপন ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে কর্মহীন হয়ে তারা পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
শ্রমিকদের গেটপাসে নামের বানান ভুলসহ নানা অজুহাতে এখনও অনেক শ্রমিককে টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ২০১৫ সালের ‘মজুরি কমিশন’-এর ঘোষণা অনুযায়ী মজুরি কাঠামো মোতাবেক শ্রমিকরা পারিশ্রমিক পেয়েছেন। সুতরাং বকেয়া এরিয়ারের অর্থ এবং সেই সঙ্গে ২০১৫ সালের মজুরি কাঠামো অনুযায়ী বিভিন্ন উৎসব বোনাসের ডিফারেন্স (বর্ধিত অংশ), নোটিশ পে, লকডাউনের টাকা পান নি। এগুলো তাদের কোনো করুণা নয়, ন্যায্য পাওনা । বকেয়া পাওনা না পাওয়াতে এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক ও নাগরিক নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন।
৯ দফা দাবির মধ্যে রয়েছেঃ (১) তৎকালীন শ্রমিক কর্মচারি ঐক্য পরিষদ (স্কপ) এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকায় শ্রমিক বিদায় নয়, ১২’শ কোটি টাকা ব্যয় করে মিলসমূহ আধুনিকায়ন করতে হবে (২) দ্রুত সময়ের মধ্যে উল্লিখিত ৫টি মিলের শ্রমিকদের বকেয়া পাওনাসহ ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন অনুযায়ী ৯টি উৎসব বোনাসের ডিফারেন্স বা বর্ধিত অংশ, ২০২০ সালের ঈদ-উল-আযহা’র বোনাস, ৩টি বকেয়া বৈশাখী ভাতা, সাপ্তাহিক ৪৮ ঘন্টার অধিক হাজিরার এরিয়ার বিল প্রদান, পাটকল চালু থাকায় ১ ও ২ জুলাই ২০২০-এর ইনক্রিমেন্টসহ সকল বেতন ও পাওনাদি পরিশোধ করতে হবে (৩) মাথাভারি প্রশাসন ও দুর্নীতিযুক্ত বিজেএমসির সংস্কার করা সহ তৎকালীন মন্ত্রী, সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্ত ও বিচার করতে হবে (৪) ইতোমধ্যে যে সকল রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল লিজ দেয়া হয়েছে সেগুলো বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে (৫) ২০১০ সালের ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং এক্ট কার্যকর করতে হবে (৬) কাঁচাপাট সরাসরি রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করতে হবে (৭) ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকল শ্রমিকদের চাকুরি স্থায়িকরণ, শিশুশ্রম নিয়োগ বন্ধ এবং দৈনিক ন্যুনতম মজুরি ৫০০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে (৮) আন্দোলনরত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মিল কর্তৃক যে সকল ফৌজদারি মামলা রয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার, সাথে সাথে শ্রমিকেরা তাদের পাওনা পরিশোধের জন্য মিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যে সকল মামলা করেছেন অনতিবিলম্বে সেগুলি নিষ্পত্তি করে তাদের পাওনাদি পরিশোধ করতে হবে এবং (৯) খুলনায় আন্দোলন চলাকালীন শ্রমিক ও নাগরিক নেতৃবৃন্দের নামে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
এ সমস্ত দাবি এখনো পূরণ হয় নি। শ্রমিকদের আন্দোলন চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে শ্রমিকদের জীবন থেকে ৫টি বছর চলে গেছে। ক্ষুব্ধ হাজার হাজার পাটকল শ্রমিকরা বিগত সরকারের কোপানলে পড়েছেন। তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকার। রাষ্ট্র ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শেখ হাসিনা শ্রমিকদের সাথে বেঈমানি করেছেন। শ্রমিকদের প্রত্যাশা, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। এই সরকার বৈষম্য দূর করার সরকার। এ সরকার শ্রমিক- কৃষক-ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন, এমন আশা না খেতে পাওয়া শ্রমিকদের। শ্রমিকদের দাবি পূরণ হলে, অধিকার বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকরা আনন্দে উদ্বেলিত হবে।# লেখক পরিচিতিঃ মুনির চৌধুরী সোহেল, আহবায়ক, গণসংহতি আন্দোলন, খুলনা জেলা।