# ক্বারীঃ মোঃ শেখ শহীদুল্লাহ্ আল আজাদ……………………………………………….
আখেরী চাহার সোম্বা হলো-ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পালিত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি স্মারক দিবস। আখেরী চাহার শোম্বা একটি আরবি ও ফার্সি শব্দ-যুগল। এর আরবী অংশ আখেরী,যার অর্থ “শেষ”এবং ফার্সি অংশ চাহার শোম্বা, যার অর্থ “বুধবার”।
মূল ঘটনাঃ- ১০ম হিজরীর শুরুতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রমেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে,নামাজের ইমামতি পর্যন্ত করতে পারছিলেন না। ২৮ সফর বুধবার প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্থ হয়ে ওঠেন। দিনটি ছিল সফর মাসের শেষ বুধবার। এই দিন কিছুটা সুস্থবোধ করায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসল করেন এবং শেষবারের মত নামাজে ইমামতি করেন। মদীনাবাসী এই খবরে আনন্দ-খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন এবং দলে দলে এসে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক নজর দেখে গেলেন।সকলে তাদের সাধ্যমতো দান-সাদকা করলেন, শুকরিয়া নামাজ আদায় ও দোয়া করলেন।
উল্লেখ্য যে, ২৯ সফর তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সফর মাসের শেষ বুধবার ছিল ৩০ তারিখ। এদিন নবী করীম সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুখ হঠাৎ কমে গেল। তিনি সকাল বেলা উঠেই হযরত আয়শা রাদিআল্লাহু তাআলা আনহাকে ডেকে বললেন, আমার জ্বর কমে গেছে। তুমি আমাকে গোসল করিয়ে দাও। সে সময় তাকে গোসল করানো হল। তিনি সুস্থ্তা বোধ করলেন। এটাই ছিল দুনিয়ার শেষ গোসল। ইমাম হাসান, ইমাম হোসাইন ও ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহাকে ডেকে আনা হলো। নাতিদ্বয়কে নিয়ে তিনি সকালের নাস্তা করেন, হযরত বেলাল রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু ও সুফফাবাসীগণ বিদ্যুতের ন্যায় এ সংবাদ মদীনার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিলেন। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। তারা বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত দলে দলে আসতে লাগলেন এবং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক নজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলেন।
বুজর্গানেদ্বীনের কিছু নির্দিষ্ট বিধি-বিধানের আলোকে ‘আখেরী চাহার শোম্বা’পালন করা হয়। শুকরিয়া দিবস হিসাবে পালিত হয়। যাতে সাধারণত গোসল করে দুরাকাত শোকরানা-নফল নামাজ আদায় শেষে রোগ থেকে মুক্তির দোয়া ও দান-খয়রাত করা হয়। বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, দরবার, খানকায় ওয়াজ-নসিহত, জিকির-আজকার, মাহফিল, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয় এই দিনটি পালন উপলক্ষে।
এদিন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে বন্ধ রাখার পাশাপাশি অফিস-আদালতে ঐচ্ছিকভাবে ছুটির দিন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সাহাবায়ে কেরামগণের আমলঃ- হুজুরের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগ মুক্তির সংবাদে সাহাবায়ে কেরাম কত খুশি ও আনন্দিত হয়েছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু পাঁচ হাজার দিরহাম ফকির মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। হযরত ওমর রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু দান করলেন সাত হাজার দিরহাম। হযরত ওসমান রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু দান করলেন ১০ হাজার দিরহাম। হযরত আলী রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু দান করলেন ৩ হাজার দিরহাম। সবচেয়ে বেশী দান করলেন,ধনী ব্যবসায়ী হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু। তিনি একশত উট আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিলেন (সুবহানআল্লাহ)। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটু শান্তি ও আরামের সংবাদে সাহাবীগণ কীভাবে জান-মাল উৎসর্গ করে দিতেন এটা তারই আংশিক প্রমাণ।
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু প্রতি বৎসর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাময়িক রোগ মুক্তির দিবসকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য পারস্যসহ মধ্য এশীয়া পাক ভারত উপমহাদেশে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই দিবসটি পালন করা হয়। বুজুর্গাণে দ্বীনের ত্বরিকা অনুযায়ী এ দিনে নবীজীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্মরণে এবং রোগ বালাই থেকে মুক্তির নিয়তে আখেরী চাহার শোম্বা দিবসে গোসল করে দুই রাকাত শুকরিয়া নামায আদায় করা হয়। এছাড়াও বৈধ সমস্ত নেক আমল করা হয়।
কোরআন মাজিদের ৬টি আয়াতে শেফাও সাত সালামের আয়াত চিনির প্লেটে বা কলা পাতায় লিখে পানিতে ধৌত করে ঐ পানি পান করলে পাইলস বা গেজ রোগ নিরাময় হয় বলে বুজুর্গানে দ্বীন ফাযায়েলের কিতাবে লিখে গেছেন। আখেরী চাহার শোম্বাহ বা সফরের শেষ বুধবার দিবসটি পালন করে মুসলমানরা ইসলামের একটি স্মরণীয় দিনকে এখনো প্রেরণার উৎস করে রেখেছে। মূলতঃ এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ইসলামী জোশ বারবার চাঙ্গা হয়ে উঠে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মৃতি বিজড়িত এই দিবসটি পালন করতে এক শ্রেনীর ওলামা নিষেধ করেন এবং এটাকে বিদআত বলে মানুষকে ভয় দেখান। তাদের উদ্দেশ্য একটি- সেটি হলো, ইসলামের স্মরণীয় ঘটনাসমূহ মুসলমানদের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা।
নবী-অলিদের স্মৃতি বিজড়িত চিহ্ন সংরক্ষণ করা ও দিবস পালনের মধ্যে অজস্র কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এজন্যই কোরআন মাজিদে পূর্ববর্তী নবীগণের বিভিন্ন স্মরণীয় দিনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে মানুষ ঐগুলো থেকে হেদায়াতের আলো লাভ করতে পারে। ঐসব স্মরণীয় দিনগুলোকে আল্লাহপাক কোরআন মজিদে“ইয়াওমিল্লাহ” বা “আল্লাহর স্মরণীয় দিবস” বলেছেন।
আখেরী চাহার শোম্বাহর গোসলটি ছিলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের শেষ গোসল। এরপর ছিলো জানাযার গোসল। আখেরী চাহার শোম্বার দিন বিকাল থেকেই পুনরায় জ্বর দেখা দেয়। এই জ্বরেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ দিন পর ইন্তেকাল (দুনিয়া থেকে পর্দা) করেন। সুতরাং সফরের শেষ বুধবার একদিকে খুশির দিন অপর দিকে শোকেরও দিন। সকালে আনন্দ বিকালে বিষাদ কিন্তু দুটি একসাথে হলে প্রথমটি পালন করতে হয়। যেমন-১২’ই রবিউল আউয়াল।
দিবস পালনের গুরুত্বঃ- স্বরণীয় দিনগুলোর উল্লেখ করে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,“হে বনী ইসরাঈল! তোমরা ঐ দিনের ঘটনা স্বরণ কর। যেদিন আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ফেরআউনের অত্যাচার থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে সদলবলে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। “[সুরা বাকারা]”তাই তারা আশুরার দিনে রোজা রাখতো। আমরাও হুযুরের বেলাদত দিবস পালন করি। যেমন-আল্লাহ্ পাক বলেন,“হে প্রিয় হাবীব! ঐ দিনকে স্বরণ করুন- যে দিন আল্লাহ তায়ালা সমস্ত নবীকে একত্রিত করে আপনার সম্পর্কে এই মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে,যখন তোমাদেরকে নবুয়ত, কিতাব ও হিকমত দিয়ে সম্মানিত করা হবে আর সবার পরে তোমাদের নবুয়তের সত্যায়নকারী মহান রসূলকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরণ করা হবে- তখন তোমরা তার উপর অবশ্য অবশ্যই ঈমান আনবে এবং অবশ্য অবশ্যই তাকে সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগীতা করবে।”-[সুরা আলে ইমরান ৮১ আয়াত] ★মহান আল্লাহ তায়ালা যেন সকলকে আমল করার তাওফিক দান করেন।#