
ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে আলেম সমাজ কেবল ধর্মীয় পথপ্রদর্শক নন, বরং তারা ছিলেন সামাজিক ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং দেশপ্রেমের অগ্রদূত। ১৭৫৭ সালের পলাশী বিপর্যয় থেকে শুরু করে ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত—যেকোনো রাষ্ট্রীয় অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে আলেমদের ভূমিকা এক অমলিন ও অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস।
১. আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ.)-এর দর্শন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.) ১৮০৩ সালে ভারতকে ‘দারুল হরব’ (শত্রু কবলিত দেশ) ঘোষণা করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ইমানি দায়িত্ব হিসেবে সাব্যস্ত করেন। এটিই ছিল উপমহাদেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা, যা পরবর্তী দেড়শ বছরের আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
২. সশস্ত্র বিপ্লব ও প্রাথমিক প্রতিরোধ (১৭৫৭-১৮৫৭) ব্রিটিশ শাসনের প্রথম একশ’ বছর আলেম সমাজ সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দিয়েছেন:
বালাকোটের মহাকাব্য: সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভী ও শাহ ইসমাইল শহীদ (রহ.)-এর নেতৃত্বে ‘মুজাহিদ আন্দোলন’ ইংরেজ ও তাদের মিত্রদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ১৮৩১ সালের বালাকোটের লড়াই ছিল আলেমদের রক্তে লেখা এক মহাকাব্য।
বাংলার প্রতিরোধ: তিতুমীরের ‘বাঁশের কেল্লা’ এবং হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়ার ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নীলকর ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ কৃষকদের সংগঠিত করে এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহ: আল্লামা ফজলুল হক খায়রাবাদী ও মাওলানা আহমাদুল্লাহ শাহের সরাসরি নেতৃত্বে হাজার হাজার আলেম স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মতে, এই বিদ্রোহের পর আলেমদের দমন করতে হাজার হাজার আলেমকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
৩. বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম ও দেওবন্দ আন্দোলন (১৮৬৬-১৯৪৭) সশস্ত্র যুদ্ধে সাময়িক বিপর্যয়ের পর আলেম সমাজ কৌশল পরিবর্তন করেন: দারুল উলুম দেওবন্দ (১৮৬৬): মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.) এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি কেবল একটি মাদ্রাসা ছিল না, বরং ছিল ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার সূতিকাগার। রেশমি রুমাল আন্দোলন: শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসানের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশ বিরোধী নেটওয়ার্ক গঠন করা হয়, যা ইতিহাসে এক দুঃসাহসিক বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা হিসেবে স্বীকৃত।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব: মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর নেতৃত্বে ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ এবং খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে দেশব্যাপী গণজাগরণ তৈরি হয়, যা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিদায় নিশ্চিত করে। ৪. ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লব ও আলেমদের ভূমিকা দীর্ঘকাল পর ২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আলেম ও মাদ্রাসা ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
প্রতিরোধের সম্মুখভাগ: ১৮ জুলাইয়ের পর যখন রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা আন্দোলন দমনে চরম বলপ্রয়োগ শুরু করে, তখন যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা, শনির আখড়া এবং সাভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রতিরোধের মূল দেওয়াল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
শহীদি কাফেলা: এই বিপ্লবে শহীদদের তালিকা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একটি বিশাল অংশ মাদ্রাসার ছাত্র। সাভারে পুলিশের এপিসি থেকে ফেলে দিয়ে নৃশংসভাবে শহীদ করা শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন, কিংবা যাত্রাবাড়ীর রাজপথে অকাতরে প্রাণ দেওয়া অসংখ্য কওমি শিক্ষার্থীর রক্ত এই বিপ্লবকে চূড়ান্ত রূপ দান করে।
জাতীয় ঐক্য: এই বিপ্লবের মাধ্যমে মাদ্রাসা এবং সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের কৃত্রিম দূরত্ব ঘুচে গিয়ে এক ‘জাতীয় ঐক্য’ তৈরি হয়েছে।
৫. আলেমদের আত্মত্যাগের সংক্ষিপ্ত খতিয়ান ইতিহাসের পাতায় আলেমদের ত্যাগের চিত্রটি অত্যন্ত বিশাল: ব্রিটিশ আমল: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর দিল্লি থেকে খাইবার পর্যন্ত রাস্তার দুপাশের গাছগুলোতে আলেমদের ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রায় ২ লক্ষ আলেম ও মুসলমান এই দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনে শহীদ হন।
শামলী ও মাল্টা: শামলীর যুদ্ধে আলেমদের রক্ত এবং শাইখুল হিন্দের মাল্টা দ্বীপের বন্দিজীবন আজাদির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
২০২৪-এর বিপ্লব: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আলেম-ছাত্রদের রক্ত কেবল স্বৈরাচারের পতন ঘটায়নি, বরং তারা প্রমাণ করেছেন যে দেশপ্রেম ও ঈমান একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। উপসংহার ১৭৫৭ থেকে ২০২৪—সময়ের ব্যবধান প্রায় ২৬৭ বছর। কিন্তু এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আলেম সমাজের লক্ষ্য ছিল অভিন্ন: ‘শোষণমুক্ত ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ গঠন’। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তারা যেমন সম্মুখ সমরে থেকে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন, ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের তপ্ত রাজপথেও তারা একইভাবে বুক পেতে দিয়েছেন বুলেটের সামনে। আলেমদের এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা প্রমাণ করে যে, তারা কেবল পরকালের পাথেয় সংগ্রহকারী নন, বরং ইহকালের ইনসাফ কায়েমের অতন্দ্র প্রহরী। ইতিহাসের এই ঋণ স্বীকার এবং আলেম-সাধারণ শিক্ষার্থীর এই নতুন ভ্রাতৃত্বই আগামী দিনের সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার মূল শক্তি!…
# লেখক একজন শিক্ষক কবি গবেষক ও প্রাবন্ধিক