ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম………
ভূমিকা মানুষ সামাজিক জীব, আর কথা বা বাক্-আলাপ হলো সামাজিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ব্যক্তির চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় তার কথার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মগ্রন্থই মানুষকে সুন্দর, শালীন ও মানবিক আচরণের শিক্ষা দেয়, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কথা বলার শিষ্টাচার বা আদব-কায়দা। পবিত্র আল-কুরআন, হাদিস এবং অন্যান্য প্রধান ধর্মগ্রন্থ যেমন বেদ, ত্রিপিটক, বাইবেল ইত্যাদিতে মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। এই নিবন্ধে সেই মূলনীতিগুলো তুলে ধরা হলো।
কথা বলার মৌলিক নীতি ও শিষ্টাচার বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের আলোকে মানুষের সাথে কথা বলার কিছু সাধারণ ও মৌলিক আদব-কায়দা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. নম্রতা ও শালীনতা সকল ধর্মেই কঠোরতা ও রূঢ়তাকে প্রত্যাখ্যান করে নম্র ও কোমল ভাষায় কথা বলার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল-কুরআন ও ইসলাম: ইসলামে সবসময় নরম ও মিষ্টি ভাষায় কথা বলার নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা মূসা (আ.) এবং হারুন (আ.)-কে ফিরআউনের কাছে যাওয়ার সময়ও “নম্র কথা” (ক্বাওলান লাইয়্যিন) বলার নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা ত্বাহা: ৪৪)। বিশেষ করে পিতা-মাতার সাথে “উহ্” শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং তাদের সাথে “নম্রতার পক্ষপুট অবনত করে” কথা বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (সূরা বনী ইসরাঈল: ২৩-২৪)। খ্রিস্টধর্ম (বাইবেল): নিউ টেস্টামেন্টে বলা হয়েছে— “তোমাদের কথা যেন সর্বদা অনুগ্রহপূর্ণ হয়, লবণে সুস্বাদু করা হয়, যাতে তোমরা প্রত্যেককে কেমন উত্তর দিতে হয়, তা জানতে পারো।” (কলসীয় ৪:৬)। সনাতন ধর্ম (বেদ ও উপনিষদ): ‘সত্যং ব্রূয়াৎ প্রিয়ং ব্রূয়াৎ ন ব্রূয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্’ – অর্থাৎ, সত্য বলো, প্রিয় কথা বলো, অপ্রিয় সত্য বলো না। এটি সবসময় সত্য বলার পাশাপাশি প্রিয়ভাবে বলার ওপর জোর দেয়।
২. অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার ও সময়মতো কথা বলা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বা মিথ্যা কথা বলাকে সব ধর্মই নিন্দনীয় মনে করে। আল-কুরআন ও ইসলাম: মুমিনদের গুণাবলীর মধ্যে “অনর্থক ও বাজে কথা থেকে বিরত থাকা” কে অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা মুমিনূন: ৩)। বৌদ্ধধর্ম (ত্রিপিটক): বুদ্ধের নির্দেশিত পঞ্চশীলের মধ্যে একটি হলো ‘মুসাবাদা ভেরামণি সিক্খাপাদং সমাদিয়ামি’ — যার অর্থ মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকা। এর পাশাপাশি তিনি অপ্রিয়, কঠোর ও পরনিন্দা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছেন।
৩. সত্যনিষ্ঠা ও প্রতিজ্ঞা রক্ষা কথা বলার ক্ষেত্রে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা এবং নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা সকল ধর্মের আবশ্যিক শিক্ষা। আল-কুরআন ও ইসলাম: আল্লাহ্র নির্দেশ, “আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জানা সত্ত্বেও সত্য গোপন করো না” (সূরা বাকারা: ৪২)। খ্রিস্টধর্ম (বাইবেল): জেমস-এর পত্রে বলা হয়েছে— “কিন্তু তোমাদের কথা ‘হ্যাঁ’ যেন ‘হ্যাঁ’ হয়, এবং ‘না’ যেন ‘না’ হয়; পাছে তোমরা বিচারের অধীনে পড়।” (জেমস ৫:১২)।
৪. সম্মান ও মনোযোগ সহকারে শোনা অন্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কথা বলা এবং মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনাও শিষ্টাচারের অংশ। আল-কুরআন ও ইসলাম: নবী (সাঃ)-এর মজলিসে সাহাবিদের উচ্চস্বরে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছিল (সূরা হুজরাত: ২)। এটি অন্যদের প্রতি সম্মান এবং বিনয়ের গুরুত্ব বোঝায়। সনাতন ধর্ম: গুরু বা জ্ঞানীদের কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা এবং বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করাকে উচ্চমানের শিষ্টাচার হিসেবে দেখা হয়।
৫. ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও উপহাস থেকে বিরত থাকা কাউকে নিয়ে উপহাস, মন্দ নামে ডাকা বা খারাপ ধারণা পোষণ করা সব ধর্মে কঠোরভাবে নিষেধ। আল-কুরআন ও ইসলাম: “হে মুমিনগণ, কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষকে উপহাস না করে… আর তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং মন্দ নামে ডেকো না…” (সূরা হুজরাত: ১১)।
কুরআনের আলোকে কথা বলার সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা পবিত্র কুরআন মানুষকে কথা বলার ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করেছে: ১. কথা বলার আগে সালাম দাও: কাউকে সম্বোধন বা আলাপ শুরু করার আগে সালাম দেওয়ার মাধ্যমে শান্তি ও কল্যাণ কামনা করা (সূরা আন-নূর: ৬১)। ২. কথা বলার সময় সতর্ক থাকো: প্রতিটি উচ্চারিত শব্দ রেকর্ড করা হচ্ছে, এই বিশ্বাস রেখে কথা বলা (সূরা কাফ: ১৮)। এটি প্রতিটি কথার জন্য জবাবদিহিতার মনোভাব সৃষ্টি করে। ৩. সুন্দর ও উত্তমভাবে কথা বলো: মানুষের সাথে সবসময় সুন্দর ও সদাচারমূলক কথা বলা, যা সম্পর্ককে মধুর করে তোলে (সূরা বাক্বারাহ: ৮৩)। ৪. অনর্থক ও বাজে কথা থেকে বিরত থাকো: মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এমন কথা ও কাজ পরিহার করা যা কোনো কাজে আসে না (সূরা আল-মুমিনূন: ৩)। ৫. কণ্ঠস্বর নিচু রাখো: অহেতুক চিৎকার বা উচ্চস্বরে কথা না বলা; কারণ উচ্চস্বরকে অপ্রীতিকর হিসেবে গণ্য করা হয়েছে (সূরা লুকমান: ১৯)। ৬. বুদ্ধি ও চিন্তা ব্যবহার করে কথা বলো: কথা বলার আগে চিন্তা করা এবং হঠকারিতা পরিহার করা। ৭. গাধার মতো কর্কশ স্বরে কথা বলো না: কথা বলার ক্ষেত্রে রূঢ়তা ও কর্কশতা পরিহার করে মধ্যম স্বর অবলম্বন করা (সূরা লুকমান: ১৯)। ৮. মূর্খ ও অজ্ঞদের সঙ্গে ঝগড়া নয়: যারা মূর্খতাপূর্ণ কথা বলে, তাদের সাথে তর্কে না জড়িয়ে শান্তভাবে ‘সালাম’ জানিয়ে (বা শান্তি কামনা করে) তাদের এড়িয়ে চলা (সূরা ফুরকান: ৬৩)।
উপসংহার কুরআন, হাদিস এবং অন্যান্য প্রধান ধর্মগ্রন্থসমূহের মূল বার্তা হলো – মানুষের সাথে কথা বলার সময় বিনয়, সত্যবাদিতা, নম্রতা, শ্রবণ মনোযোগ এবং পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখা। ধর্মীয় নির্দেশনাগুলো একথাই প্রমাণ করে যে, উত্তম বাচনভঙ্গি কেবল একটি সামাজিক গুণ নয়, বরং এটি একটি গভীর নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। আমাদের কথায় যেন কোনোভাবে কেউ আঘাত না পায়, সেই বিষয়ে সর্বদা সচেতন থাকা উচিত। কারণ, একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে কথা বলার শিষ্টাচারই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ..!
লেখক: একজন শিক্ষক গবেষক ও নিবন্ধকার!