আবুল কালাম আজাদ…………………………………………………….
নির্মল ও শান্ত পরিবেশ নিয়ে উত্তরের এই বিভাগীয় শহরটির ইতিমধ্যেই রয়েছে দেশজুড়ে ব্যাপক খ্যাতি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আলোকিত এই নগরীর পরিবেশ মুগ্ধ করবে যে কাউকেই।
বাংলাদেশের ক্লিন সিটি খ্যাত রাজশাহীর কথা। দেশের প্রতিটি শহরের মতোই এই ক্লিন সিটিরও রয়েছে এক অন্য ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসেই রয়েছে এই শহরের নাগরিকদের গর্ব। আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রাচীন সব ইতিহাস যেন চাপা পড়ে গেছে। কিন্তু সেই ইতিহাসের কিছু কিছু নিদর্শনের ছোঁয়া যেন রয়ে গেছে আধুনিকতার মাঝেও ।
ঠিক তেমনই আধুনিক এই ক্লিন সিটি রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে এখনও দেখা যায় প্রাচীন ঐতিহ্যের কিছু কিছু নিদর্শন। আর এমনই এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো রাজশাহীর ঢোপকল। একসময়ের সুপেয় পানি সরবরাহব্যবস্থা হিসেবে গড়ে ওঠা ঢোপকল রাজশাহী শহরের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্য। এই ঢোপকলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজশাহীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীবাসীর জন্য সার্বক্ষণিক বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে মহারানি হেমন্ত কুমারীর প্রচেষ্টা ও অনুদানে তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রায় ডি এন দাশগুপ্তর তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী এই ঢোপকল।
সে সময় রাজশাহী শহরে পানযোগ্য পানির অভাবে শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা-আমাশয় সহ নানারকম পেটের পীড়া। মৃত্যুও ঘটে অনেক মানুষের। সে সময় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় । নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন পৌরসভার চেয়ারম্যান রায় ডিএন দাশগুপ্ত।
মিনিষ্ট্রি অব ক্যালকাটার অধীনে রাজশাহী ওয়াটার ওয়াকর্স নামে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ব্যয় করা হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকাও বেশি। তখন হেমন্তকুমারী নিজেই দান করেন প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। বিশাল অঙ্কের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ডের দান করা জমিতে মহারানি হেমন্ত কুমারীর নামেই ওয়াটার ওয়ার্কস স্থাপিত হয়। কালক্রমে তার নাম হেমন্তকুমারী ঢোপকল নামেই পরিচিত হতে থাকে।
পুরো শহর জুড়ে প্রায় শতাধিক এমন ঢোপকল স্থাপন করা হয়। মহারানি হেমন্তকুমারী পানি শোধন কেন্দ্রে পানিকে বিভিন্ন ট্রিটমেন্ট করে পানি থেকে আয়রন ও পানির ক্ষারতা দূর করা হতো। তারপর সেটা সরবরাহ করা হতো সেই ঢোপগুলোতে।
তবে সর্বপ্রথমে সেটা পাথরকুঁচির ফিল্টার দিয়ে পানি ফিল্টার করা হতো। এরপর সেটা সিমেন্টের তৈরী মোটা পাইপের সাহায্যে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। এই ঢোপকলগুলোর প্রতিটির পানি ধারণক্ষমতা ৪৭০ গ্যালন।
প্রতিটি ঢোপকলেই ছিল একটি রাফিং ফিল্টার। এতে বালি ও পাথরের স্তর থাকায় সরবরাহ করা পানি আরও পরিশোধিত হয়ে বের হতো এবং গরমের সময় মোটামুটি ঠান্ডাও থাকতো। সেই সময় সারাদিনে মাত্র দুই ঘণ্টা পানি সরবরাহ করা হতো।
মোড়ে মোড়ে ঢোপকলগুলোতে পানি ধরে রাখা হতো। ফলে সারাদিনই পানি পেত নগরবাসী। নিয়ম করে ব্লিচিং পাউডার ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে প্রতি দুই মাস পর পর এই ঢোপকলগুলোকে পরিষ্কার করা হতো। খোলা যেত ঢোপকলের উপরের ঢাকনাটিও।
প্রতি দুই মাস পর পর প্রত্যেকটি ঢোপকল থেকে পানির স্যাম্পল সংগ্রহ করা হতো। পরে সেটা পাঠানো হতো পরীক্ষাগারে পানির মান ঠিক আছে কিনা সেটা দেখার জন্য।
ঢোপকলগুলো লম্বায় প্রায় ভূমি থেকে ১২ ফুট উঁচু এবং ব্যাস প্রায় ৪ ফুট। ঢোপকলগুলো তৈরি করা হয়েছিল সিমেন্টের ঢালাই করে। এই ঢোপকলের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো একটা প্লাষ্টার করা হতো। যে নকশাটা করা হতো টিনের সাহায্যে।
চারিদিকে টিনের একটা রাউন্ড বানিয়ে তার মধ্যে সিমেন্ট আর ইটের খোয়ার ঢালাই ঢেলে দেয়া হতো। এর ঢালাই খুবই শক্ত। সহজে কোনো কিছুর ধাক্কায় বা আঘাতে এটা ভাঙ্গে না। তবে এই ঢোপকলগুলোর অধিকাংশই বর্তমানে বিলুপ্ত।
মহানগরীর বেলদারপাড়া, ফায়ারব্রিগেড মোড়সহ হাতেগোনা কিছু এলাকায় কয়েকটি ঢোপকল থেকে এখনো পানি সরবরাহ করা হয়। তবে ঢোপকলের জন্য পানি সরবরাহের যে ব্যবস্থা চালু ছিল, সেটা এখন আর নেই।
ঢোপকলে পানির সংযোগ এখন মহানগরীর উপকণ্ঠে স্থাপিত পানি শোধনাগারের সঙ্গে। রাজশাহীর ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য কিছু ঢোপকল চালু রাখা যেতে পারে। যেগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে রাজশাহী মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু মোড়ে।
নগরীরর বাসিন্দা মিলন বলেন, রাজশাহীর ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এই ঢোপকল। তবে সময়ের সাথে সাথে এই নিদর্শন গুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে হাতে গোনা কয়েকটি ঢোপকলের মধ্যে রাস্তার পাশে থাকায় নগরীর সৌন্দর্য বাড়াতে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন সাজে।
নগরীরর আরেক বাসিন্দা সাজু বলেন, আমাদের বাপ-দাদার আমলে এই ঢোপকল থেকে শুদ্ধ পানি পান করতাম। তবে এখন সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সাপলাই পানির ব্যবস্থার করায় ঢোপকল গুলো অপরিষ্কার ও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।#