জিয়াউল কবীর স্বপন : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হয়েছে। আজ রোববার সকাল ১০ টায় প্রশাসন ভবন-১-এর সামনে জাতীয় সংগীত পরিবেশন, পতাকা উত্তোলন এবং বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুরু হয়। পরে সেখান থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদিক্ষণ শেষে সিনেটে ভবনের সামনে শেষ হয়। সেখানেই হয় আলোচনা সভা।
সভায় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার, উপাচার্য প্রফেসর সালেহ্ হাসান নকীবসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতনরা।
বক্তারা বলেন, প্রতিষ্ঠার ৭১ বছর পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। শিক্ষার্থীদের খাবার, আবাসন, গবেষণা, চিকিৎসাসহ নানা খাতে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব সমাধান করে আন্তর্জাতিক মানের বিদ্যাপীঠে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। ২৪ এর বিপ্লবের হাত ধরে সেই অগ্রযাত্রা আরো ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করেন আলোচকরা।
১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই মাত্র ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শহিদ ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিবিজড়িত এই বিদ্যাপীঠের রয়েছে গৌরব-ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ ইতিহাস। বর্তমানে পরিসর বেড়ে ১২টি অনুষদের আওতায় ৫৮টি বিভাগে চার বছর মেয়াদি স্নাতক এবং এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তরে প্রায় ৩৮ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। এমফিল ও পিএইচডিসহ উচ্চতর গবেষণার জন্য রয়েছে ৬টি ইন্সটিটিউট। রয়েছেন প্রায় হাজার শিক্ষক। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য বিভিন্ন ভাবে যারা অবদান রেখেছেন তাঁদেরকে স্মরণ করা হয়েছে। পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী মাদার বখশ, আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ এমএলএ, ইদ্রিস আহমেদ এমএলএ, অধ্যাপক ইৎরাত হোসেন জুবেরী, এডভোকেট আয়েন উদ্দীন, খোরশেদ আলম, আনসার আলী, আব্দুল জব্বার প্রমূখ ব্যক্তিবর্গকে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই। হাজারো স্মৃতিকে বুকে নিয়ে ১৯৫৩ সাল থেকে দেশের উচ্চ শিক্ষায় অবদান রেখে আসছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। নানা আন্দোলন সংগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান গৌরবোজ্জ্বল হয়ে আছে। রাজশাহী এলাকার শিক্ষাদিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৩ সালে রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠা করা । সে সময় কলেজে কিছু কাল আইন বিভাগ সহ পোষ্ট গ্রাজুয়েট চালু ছিল, অল্প সময় পরেই এ সকল শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উচ্চ শিক্ষার জন্যে ঐ সময়ই রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর রাজশাহীতে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়।
১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রথম দাবি অবশ্য ওঠে রাজশাহী কলেজেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন পূর্ববঙ্গীয় আইনসভার সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী মাদার বখশ। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গনে সমবেত হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাস করার দাবি তোলেন। রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য সর্বপ্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরের ভুবন মোহন পার্কে। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি তীব্র হতে থাকে।
১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি ৬ ভুবন মোহন পার্কে আরও একটি জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাদার বখশ সরকারকে হুশিয়ার করে বলেন, যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন না হয় তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে আমরা বাধ্য হব । মাদার বখশের এই জ্বালাময়ী বক্তব্যে সাড়া পড়ে দেশের সুধী মহলে।সাথে সাথে টনক নড়ে সরকারেরও। এভাবে ধারাবাহিক আন্দালনের মুখে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাবি প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। একই বছরের ৬ জুলাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, রাজশাহী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. ইতরাৎ হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে রাবির কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৪ সালে পদ্মাতীরের বড় কুঠি নামে পরিচিত ঐতিহাসিক রেশম কুঠির উপর তলায়। সাতটি বিভাগে ১৫৬ জন ছাত্র এবং পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস শুরু হয় রাজশাহী কলেজে। উপাচার্যের দফতরও প্রতিষ্ঠা করা হয় পদ্মার তীরের বড়কুঠি নামে পরিচিত ঐতিহাসিক রেশম কুঠির উপর তলায়।
১৯৫৮ সালে বিদ্যমান বর্তমান ক্যাম্পাসের দালান-কোঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ শুরু হয়।এরপর ১৯৬১ সালে রাবির শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয় মতিহারের সবুজ চত্বরে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অফিস ও বিভাগ এখানে স্থানান্তরিত করতে করতে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এভাবে পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হয় একটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনায় এই ক্যাম্পাসটি গড়ে ওঠে এবং অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি ড. সোয়ানি টমাস এর স্থাপত্য পরিকল্পনা করেন। উল্লেখ্য নতুন ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান এটি পরিদর্শন করেন বলে রাবি রেজিস্ট্রার ইফতেখারুল ইসলাম মাসুদ সাংবাদিকদের জানান।#