বিশেষ প্রতিনিধি: ৪০ বছর ধরে মেলায় আসা কুষ্টিয়ার বৃত্তিপাড়ার নগেশ্বর জানান, ১৫ বছর বয়স থেকে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে মেলায় আসছেন। প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে ৩/৪ হাজার টাকা। পোড়ামাটি আর বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি সেসব খেলনা, বেঙগাড়ি(টমটম) নিয়ে মেলায় পসরা সাজিয়ে বসেছেন ৭৫ বছর বয়সের বগুড়ার ওসমান আলী। ৩৫ বছর ধরে আসছেন বাঘার মেলায়। ষাটের দশকে প্রতিটি খেলনা বিক্রি করেছেন এক টাকার নীচে। এখন বিক্রি করছন ১২ থেকে ১৫ টাকায়।
তিনি জানান, কালের বির্বতনে নতুনত্ব খেলনা সামগ্রীর কারনে এবারে অন্যান্য বছরের তুলনায় বিক্রি কম। এর পরেও ২৫ /৩০ হাজার টাকা বিক্রির আশা করছেন । খুলনা থেকে আসা কসমেটিকস ব্যবসায়ী মেরাজ গাজী, ঈদের ৩ দিন আগে মেলায় এসেছেন। সোমবার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা বেচা কেনা হয়েছে তার। গত বছর বেশি হয়েছিল। মেলার আগের দিন থেকে পাইকারি ও খুচরা মিলে সাড়ে চার লক্ষ টাকার খেলনা সামগ্রী বিক্রি করেছেন পাইকারি বিক্রেতা সহিদুল ইসলাম ।
হিজলপল্লী গ্রামের মিষ্টির দোকানদার সাইফুল ইসলাম, সোমবার পর্যন্ত তার আড়াই লাখ টাকার বেশি বেচা কেনা করেছন। প্রথম মেলায় আসা,কুঠির শিল্পের স্বত্ত্বাধিকারী নওগার পরিতোষ মন্ডল জানান,সোমবার পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ টাকার বেচা কেনা করেছেন।
আরেক পণ্য সামগ্রী বিক্রেতা টাঙাইলের রেহেনা বেগম জানান, দেড় লাখ টাকার বিক্রি করেছেন। মঙ্গলবার (০৮-০৪-২০২৫) মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, ছাট বড় মিলে প্রায় ৩ শতাধিক ষ্টলে বিভিন্ন পণ্যর পসরা ছাড়াও ভ্রাম্যমান দোকানও রয়েছে মেলায়। আম,ধান,পাট আখ সমৃদ্ধ এলাকা বাঘায় বছর ঘুরে আসে ঈদ মেলা। রেওয়াজ অনুযায়ী ছানার তৈরি জিলাপি, চমচম নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন বাজুবাঘার রবিউল ইসলাম ।
মা-বাবার সাথে মেলায় এসে শখের একটি পুতুল কিনেছেন নিম্ন বিত্ত পরিবারের ৪ বছর বয়সের রোজা। তাদের মতো ছোট-বড় সব সম্প্রদায়ের মানুষের দেখা মেলে রাজশাহীর ঐতিহাসিক বাঘার মেলায় আনন্দ উপভোগ করতে। বিনোদন ছাড়াও মেলায় কিনছেন পছন্দের পণ্য সামগ্রী, শিশুদের খেলনা, প্রসাধনী, কুটির ও হস্তজাত দ্রব্য,আসবাবপত্র, মুড়ি-মুড়কি, ভিন্ন ভিন্ন সাধের মিষ্টান্নসহ বহু কিছুই। শিশু,বালক-বালিকাদের বেশি চাহিদা ছিল বিনোদন ও খেলনা সমাগ্রীর দিকে। নারিরা কিনেছেন গহনা, বাঁশ ও লোহার সামগ্রী।
বাজুবাঘার ফার্নিচার ব্যবসায়ী আব্বাস উদ্দীন জানান, গত বছর বিক্রি করেছিলেন ২ লক্ষ টাকা। মেলা বেশিদিন স্থায়ী হলে গত বারের চেয়ে বেশি বিক্রির আশা তার।
পঁচিশ বছর ধরে ভ্রাম্যমান লাইব্রেরির দোকান নিয়ে আসা আলা উদ্দীন জানান,এখন আগের মতো বই বেচা কেনা হয়না। তবে মেলায় পরিচিত অপরিচিত অসংখ্য লোকজনের সাথে দেখা হয়। ৭৫ বছর ধরে ভ্রাম্যমান হোটেল বসিয়ে মেলায় বেচা বিক্রি করেন ৯০ বছর বয়সের জমসেদ আলী । এবার তার হোটেলে বেচা বিক্রি কম হয়েছে। কারণ হিসেবে বলেন, আগে রাতভর জুয়া,যাত্রাগান হতো। দুরের মানুষ এসে খাওয়া দাওয়া করতো। অল্প পুঁজিতে ভালো লাভ হয়েছে গ্যারেজ মালিক ও ভ্যান চালকদের।
মেলার প্রাণচাঞ্চল্য দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করে ও মেলায় আসার স্মৃতিচারণ করে নাট্যকার নির্মাতা ফিরোজ আহমেদ শিমুল সরকার বলেন, দিনে দিনে গুছিয়ে রাখা টাকা দিয়ে মেলায় কেনাকাটা ছিলো মহা আনন্দের। ৫ মাইল দুরে পায়ে হেঁটে বাঘার মেলায় যাওয়াই ছিলো ঈদের মূল আনন্দ।
মিলিক বাঘার ৬৮ বছরের সেকেন্দার আলী মেলার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ছোট বেলায় দলবেঁধে মেলায় এসে, পুতুল নাচ,বাইশস্কোপ দেখাসহ তাল পাতার ও বাঁশের বাঁশি কেনা আর সন্ধ্যার পর নাটক-যাত্রা গান শুনতে। এখন মেলা থেকে তাল পাতার বাঁশি কেনা হয়না। শোলার খেলনা, বেতঁ এর তৈরি সরঞ্জাম মাটির তৈরি পশু-পাখি মেলায় আর দেখা যায়না। আগে বেশীর ভাগই দোকান ছিল মিষ্টান্নের। পোড়াবাড়ির চমচম আর গৌরপালের মিষ্টি ছিল সবার প্রিয়। মৃৎ শিল্পীদের তৈরি মাটির হাঁড়ি-পাতিলে মিষ্টি নিয়ে যেতেন বাড়িতে।
ষোল বছর পর,মেলায় এসে খোলামেলা ভাবে কুশল বিনিময় করেছেন বিএনপি, জামায়াত,এনসিপির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তবে দেখা মেলেনি আত্মগোপনে থাকা আ’লীগ নেতাদের। শাহদৌলা সরকারি কলেজের প্রভাষক আব্দুল হানিফ জানান,মেলা এখন সর্বজনীন উৎসব ও ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। মানুষ বেড়ে গেছে, সে সঙ্গে বেড়েছে দর্শক-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মেলার কলেবর বেড়েছে বহুগুনে। যেহেতু সাধারণ নাগরিকের প্রাত্যহিক বিনোদনের কিছু নেই।
জানা যায়, হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রঃ) ও তার ছেলে হযরত আব্দুল হামিদ দানিশমন্দ (রঃ) এর মৃত্যুর পর ওফাৎ দিবস স্বরণে প্রতিবছর ৩ শওয়াল পবিত্র ওরশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এবার হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রঃ) এর ৪৯৬ তম এবং তার ছেলে হযরত আব্দুল হামিদ দানিশমন্দ (রঃ) এর ৩৯৭ তম ওফাৎ দিবসে ওরশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাঘা ওয়াকফ এষ্টেটের মাজার পরিচালনা কমিটি বাঘা দরগা শরীফে এর আয়োজন করেন। ওরশে আসেন হাজার হাজার নারী পুরুষ। আর ওরশকে কেন্দ্র করে শুরু হয় মেলা। মেলার জন্য ১২ লাখ টাকায় ওয়াকফ এষ্টেটের মাঠ ইজারা দিয়েছেন ওয়াকফ এষ্টেটের মাজার পরিচালনা কমিটি।
ঈদের দিন থেকে মেলা স্থায়ী হয় ১০ দিন। মেলা কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম জানান, শর্ত মেনে মেলার কার্যক্রম চলছে। ১৯ শর্তের মধ্যে ডাকের সমুদয় অর্থ নগদ প্রদান,আইনশৃঙ্খলা ও পরিস্কার পরিছন্নতা বজায় রাখাসহ , যাত্রা, পুতুল নাচ, জুয়াখেলা, অশ্লিল সিডি, ব্যবসায়ীদের কাছে ১শত টাকা ফুট (দের্ঘ্য-প্রস্থের গড়) হিসাবে ও আসবাবপত্র ক্রেতাদের নিকট শতকরা ৫টাকার বেশি খাজনা আদায় না করার নির্দেশনা দেয়া হয়।
ওসি আছাদুজ্জামান বলেন,আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মেলা এলাকায় সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন আছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও মাজার পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি শাম্মী আক্তার বলেন, মেলার জন্য মাঠ ইজারা দিয়ে যে আয় হয়, তা মাজার ও মসজিদের উন্নয়ন কাজে ব্যয় হয়।#