মোঃ মমিনুল ইসলাম মুন, বিশেষ প্রতিনিধি: রাজশাহীর তানোর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিল কুমারী এখন দেশি মাছের জন্য মৃত্যুকূপে রূপ নিচ্ছে। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত কোনো বিরতি নেই, “চায়না দুয়ারি” নামে পরিচিত অবৈধ রিং জাল পেতে স্থানীয় একটি চক্র নির্বিচারে ধ্বংস করছে বোয়াল, পাবদা, গুঁচি, ছেঁড়ি, ময়া, ট্যাংরা, টাকিসহ অসংখ্য দেশি প্রজাতির রেণু ও পোনা। ফলে বিলের স্বাভাবিক প্রজনন চক্র ভেঙে পড়ছে, আর খাদ্যশৃঙ্খলেও দেখা দিচ্ছে নেতিবাচক প্রভাব।
স্থানীয় জেলে ও পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে এই জাল বাণিজ্য চলে আসছে। বিলের পশ্চিম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জেলে রহিম উদ্দিন বলেন, “পাঁচ‑দশ দিন পর পরই মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম। অথচ রিং জালে আটকে রেণুগুলো মরে যাচ্ছে আমরা হাতে তুলে ফেলার আগেই নিস্তেজ হয়ে যায়। আর বড় মাছেরও বাঁচার উপায় নেই।”
চায়না দুয়ারি রিং জাল কী? ব্যাস ২–৩ মিটার পর্যন্ত গোলাকার প্লাস্টিক রিং ও চিকন নেটের সংমিশ্রণে তৈরি এই জাল পানির নীচে সুড়ঙ্গের মতো ছড়িয়ে থাকে। মাঝখানে আটকা পড়া মাছ বেরোবার পথ খুঁজে পায় না। আইন অনুযায়ী ৪.৫ সেন্টিমিটারের কম ফাঁসের জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, অথচ এসব রিং জালের ফাঁস মাত্র ১–১.৫ সেন্টিমিটার; সব বয়সের মাছই আটকায়।২০১৯ এর ‘মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন’ অনুযায়ী, এ ধরনের জাল রাখাও দণ্ডনীয় অপরাধ।
প্রশাসনের নীরবতা বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কাছে অভিযোগ করলেও সাড়া মেলেনি বলে জানান স্থানীয় পরিবেশবাদী রহমান। এ বিষয়ে তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)‑এর মন্তব্য নেওয়ার জন্য ফোন দেওয়া হলে তিনি রিসিভ না করায় তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা হা বলেন, “অভিযোগ পেলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।
রিং জাল সবক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ।” ছোট মাছ না থাকলে হাঁস, বক, মাছরাঙাসহ জলচর পাখির খাদ্যচক্র ভেঙে পড়ে। এসব রিং জাল দ্রুত জব্দ ও ধ্বংস মৎস্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। বিল কুমারীকে ‘সংরক্ষিত অভয়াশ্রম’ ঘোষণা মাছের প্রজনন মৌসুমে (মার্চ‑জুলাই) সবধরনের জাল নিষিদ্ধ রাখতে হবে। সচেতনতা ও বিকল্প জীবিকা স্থানীয় জেলেদের ক্ষুদ্রঋণ ও অবাধ মৎস্যচাষে উৎসাহ দিয়ে অবৈধ জাল বন্ধে উদ্বুদ্ধ করা।
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এখনই ব্যবস্থা না নিলে দুই‑তিন বছরের মধ্যে বিল কুমারী থেকে দেশি বোয়াল বা পাবদার অস্তিত্ব হয়তো শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে। আইন রয়েছে, প্রযুক্তিও আছে; দরকার শুধু প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও সামাজিক সচেতনতা। ধরা পড়া রেণু‑পোনার আনুমানিক হার: দিনে ১৫–২০ কেজি সর্বোচ্চ সাজা (মৎস্য সুরক্ষা আইন, ২০১৯): ২ বছর কারাদণ্ড বা ৫০,০০০ টাকা জরিমানা, বা উভয় দণ্ড।
বিল‑পারের আবছা ভোরে যখন সবুজ কুয়াশার আড়ালে জাল পেতে বসে কিছু অসাধু জেলে, তখন দূর থেকে ভেসে আসে বক‑রাঙার করুণ ডাক। প্রশ্ন জেগে থাকে—প্রশাসনের কান কি ওই ডাক পর্যন্ত পৌঁছুবে?#