শাহীন আলম লিটন, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি !!!
ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা ৩০ খুনের মামলার আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে কুষ্টিয়ার কালীশংকরপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।
মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল ৮টায় কালীশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদ-সংলগ্ন একটি বাসায় তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ তাকে আটক করা হয়।
কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাসার ভাড়াটিয়া শাহীন বলেন, মীর মহিউদ্দিনের মালিকানাধীন তিনতলা ভবনের নিচতলায় দেড় মাস ধরে সুব্রত বাইন ও তার সহযোগী থাকতেন। এই বাড়ির পেছনের বাড়ির এক স্থানীয় বাসিন্দা মৃত কুদ্দুস আলীর ছেলে হেলাল দুই মাস আগে ৬ হাজার টাকা ভাড়ায় ভাড়া নেন। দেড় মাস আগে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে এ বাসায় তাদের উঠান। নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন, তা কখনো দেখেনি আমরা। তবে একজনকে কয়েকদিন দেখেছি, কাপড় রোদে দিচ্ছেন এবং বাইরে থেকে খাবার আনছেন। তার সঙ্গে সুব্রত বাইনের চেহারার মিল রয়েছে। অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন বলেছেন, তিনিই সুব্রত বাইন।
তিনি আরও বলেন, ভোর ৫টার দিকে বাড়ির সামনে সেনাবাহিনীর ৫ থেকে ৬টি গাড়ি আসে। গাড়ির বহরে একটি কালো মাইক্রোবাসও ছিল। প্রায় ৫০ জন সেনাসদস্য বাড়ির তালা খুলতে বলেন। তালা খোলার পর তারা দোতলা ও তিনতলায় ওঠেন। এরপর মেসের সব বাসিন্দাদের একটি কক্ষে রাখেন। এ সময় তারা মেসের ছাত্রদের বলেন, তোমাদের কোনো ভয় বা সমস্যা নাই। তোমরা বসে থাকো। এখানে অভিযান চলছে। সেনা কর্মকর্তা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন বলে ছাত্ররা জানান।
এ ছাড়া মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ফয়সাল মাহমুদ, কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তা ও সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা ওই ভবনের ভাড়াটিয়া ও আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন।
এ বিষয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের কোনো অভিযান ছিল না। হয়তো অন্য কোনো বাহিনী করেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনসহ দুজনকে আটকের বিষয়টি শুনেছি। তবে এখনও পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি কে বা কারা, কাকে আটক করেছে। তবে খবর শুনে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এখনই নিশ্চিত করে কোনো কিছু বলতে পারছি না আমরা।
কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাসার ভাড়াটিয়া সানজিদুর ও ইভান বলেন, তিনতলা বিশিষ্ট এই ভবনের নিচতলা ফাঁকা ছিল। প্রায় দেড় মাস আগে আমাদের এই বিল্ডিংয়ের পেছনের বাসার মালিকের ছেলে বাসাটি ভাড়া নিয়ে তাদের উঠান। যে দু ’জন এই বাসায় থাকতেন তারা খুব বেশি চলাফেরা করতেন না। তাদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা ও পরিচয় ছিল না। তবে পাশের ভবনের মালিক তার আত্মীয় পরিচয় দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তারা ব্যবসা করবে এবং এখানে থাকবে। এরপর থেকেই তারা দু’জন এখানে থাকতেন।
আজকে কী ঘটনা ঘটেছিল এ প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ভোর ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর একটি টিম অভিযান চালিয়ে দুজনকে আটক করে নিয়ে যায়। দরজা ভেঙে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তারা পাশের ভবনের মালিকের ছেলের সঙ্গেও কথা বলেন। আমরা জানতে পেরেছি, সুব্রত বাইন নামে একজনকে সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। সুব্রত বাইনের চেহারার সঙ্গে মিলও খুঁজে পেয়েছি আমরা। অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন আমাদেরকে তার নামও বলেছিলেন।
ভাড়াটিয়া ও স্থানীয় কয়েকজন বলেন, মঙ্গলবার ভোরে ৩ ঘণ্টা ধরে সেখানে অভিযান চালিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এলাকায় অধিকাংশ বাড়িতে মেস ভাড়া দেওয়া হয়। যে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে, সেটির সামনে পৌরসভার সাইনবোর্ডে বাড়ির মালিকের নাম লেখা মীর মহিউদ্দিন। তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মেসে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ১৮ জন ছাত্র থাকেন।
মেসের শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রায় ৩ ঘণ্টা ধরে নিচতলায় তল্লাশি চলে। ৮টার কিছু সময় পর কালো মাইক্রোবাসটি একদম গেটের সামনে চলে আসে। নিচতলা থেকে দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে হাতকড়া পরা ও মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে তোলা হয়। আরেক যুবকের কোমরে ও শরীরে দড়ি দিয়ে বাধা ছিল।
ছাত্রদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেসের পেছনের বাড়িতে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা আটকানো পাওয়া যায়। একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাদের সাড়া মিলেনি।
সুব্রত বাইন বাংলাদেশের একজন কুখ্যাত অপরাধচক্র নেতা। তাকে সচরাচর ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকায় কমপক্ষে ৩০টি খুনের মামলা রয়েছে। ২০০৩ পর্যন্ত সুব্রত বাইন ছিলেন ঢাকার অপরাধ জগতের প্রভাবশালী চক্র সেভেন স্টার গ্রুপের প্রধান। ১৯৯১ সালে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদকে হত্যার মধ্য দিয়ে নামকরা সন্ত্রাসী হিসেবে সুব্রত বাইনের অভিষেক হয়। সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
২০০১ সালে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, সুব্রত বাইন তাদের অন্যতম। পুলিশের হাতে আটক হওয়া এড়াতে সে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ভারতে সে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সে পশিচমবঙ্গে ব্যবসা গড়ে তোলেন। জমি কিনে সেখানে বাড়ি বানান।
সুব্রত বাইন, ‘বিশালের সুব্রত’ নামেও পরিচিত। মূলত তার অপরাধ সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে মগবাজারের বিশাল সেন্টারকে কেন্দ্র করে। যারপরনাই এ নাম তার। এ সেন্টারের কাছাকাছি চাংপাই নামে একটি রেস্টুরেন্টের কর্মচারী হিসেবে তার জীবন শুরু হলেও, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সে ঢাকার অপরাধজগতের একটি পরিচিত মুখে পরিণত হন।
বিশাল সেন্টারকে ঘিরেই তার চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। একসময় প্রতি বর্গফুট জায়গার জন্য ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা আদায় করা ছিল তার নিয়মিত কাজ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে সুব্রত বাইন প্রকাশ্যে অপরাধে যুক্ত হন এবং আলোচনায় আসেন। আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন প্রকাশ্যে আসেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সুব্রত বাইনের হঠাৎ বিশাল সেন্টারে আগমন ঘটে। তার মুখে দাড়ি এবং বেশ কিছু চেহারার পরিবর্তন থাকায় প্রথমে কেউ তাকে চিনতে পারেনি। কিন্তু মুরাদ নামের একজন ব্যক্তি তাকে পরিচয় করিয়ে দিলে মুহূর্তেই সেখানে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
পুলিশ তাকে ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে আটক করলেও সে আদালতে জামিন নিয়ে মুক্ত হয়। আবার ফিরে যায় পলাতক গোপন জীবনে। ২০০৯ সালে ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্সে কর্মকর্তারা পিছু ধাওয়া করলে সুব্রত বাইন নেপাল সীমান্তের কাকরভিটা শহরে ঢুকে পড়ে ও নেপালী পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। তাকে প্রকাশ্যে অশোভন আচরণের দায়ে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর জেলে রাখা হয়। পরে ঝুমকা কারাগারে নেয়া হয়। ২০১২ সালের ৮ই নভেম্বর ঐ কারাগার থেকে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ দিয়ে অন্যান্য ১০ জন কারাবন্দীর সঙ্গে সুব্রত বাইন পালিয়ে যায়। জেল ভেঙে পালানো এসব অপরাধীরা কারাগারের ভেতর টুপি তৈরির কাজ করতো এবং রাতের অন্ধকারে মাটি কেটে এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল। বাঁশ কাটার চাকু দিয়ে মাটি কেটে ২০ ইঞ্চি চওড়া ও ২২ ইঞ্চি উচ্চতার এ সুড়ঙ্গটি তৈরি করা হয়েছিল।
সুব্রত বাইন কলকাতা পুলিশের হাতে প্রথম গ্রেপ্তার হয় ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর। পরে আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে সে আবার গোপন জীবনে ফিরে যায়। নেপালের কারাগার থেকে পালিয়ে সে পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসে। ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ভারতের কলকাতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা পড়ে। পশ্চিম বঙ্গ পুলিশ গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স (এসটিএফ) যৌথ অভিযান চালিয়ে তাকে কলকাতার বহুবাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তার কাছ থেকে একটি নাইন মিলিমিটার পিস্তল উদ্ধার করা হয়। ভারতে সুব্রত বাইনের বিরূদ্ধে অনুপ্রবেশ ও অস্ত্র রাখার অভিযোগে মামলা রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অপরাধজগতের আলোচিত নাম ছিল সুব্রত বাইন। আধিপত্য বিস্তার করে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিতে তার নাম আসা ছিল তখনকার নিয়মিত ঘটনা। এসব কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য খুন-জখমের ঘটনাও ঘটেছে।#