# মোঃ আলফাত হোসেন #
বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া, বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর, দ্রুত লোপ পাচ্ছে ম্যানগ্রোভের অরন্য,সব মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সমগ্র সুন্দরবনের মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার সম্ভাবনা। আর সেই সঙ্গে বিপদ বাড়ছে সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলে। শুধু সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নয়, ম্যানগ্রোভ ধ্বংসের দাম চুকোতে হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলার উপকূলগুলোতে।
চিডর, আইলা, ফনী, বুলবুল, ইয়াস,মিধিলি,নানারকম ঘূর্ণীঝড়ের তাণ্ডব থেকে বেঁচে গিয়েছিল সমুদ্র লাগোয়া বেশ কিছু এলাকা। খুলনার কয়রা উপজেলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার উপকূলের যে অংশে ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল ছিল, সেগুলি ধ্বংস করতে পারেনি ওই প্রাকৃতিক তাণ্ডব।
ম্যানগ্রোভের জঙ্গল বিপুল জলরাশিকে আটকে দিয়েছিল,সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিশেষ করে সাতক্ষীরার উপকূলে ঢোকার পথে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়েছে বরাবর। শুধু ঝড়ের গতি আটকানোই নয়, ফুলেফেঁপে ওঠা সমুদ্রের জল থেকে ভূমিক্ষয় রোধের একমাত্র প্রতিবিধান এই ম্যানগ্রোভ।
কেন এই অবস্থা? পরিবেশ বিজ্ঞানীদের তথ্য মতে জানাযায়, “সমুদ্রের জলস্তর বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। মেরু অঞ্চলের বরফের স্তুপ দ্রুত গলছে। যত দিন যাচ্ছে পরিমাণটা বাড়ছে। আর, ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের ঘনত্ব কমে যাওয়াতেই প্রাকৃতিক ঝড় তেমন ভাবে প্রতিহত করতে পারছেনা এই প্রাকৃতিক দেওয়াল। এই ম্যানগ্রোভের শক্ত শিকড় মাটিকে টেনে রাখে। তাই এই গাছ যত কমে গিয়েছে মাটি ক্ষয়ে জলের তোড়ে ধুয়ে যাচ্ছে। একটু একটু করে জলের নিচে চলে যাচ্ছে সুন্দরবনের স্থলভূমি।
বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাওয়ার অর্থ বহু দুষ্প্রাপ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির সঙ্গে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেবে ভীষণ সুন্দর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও।
সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ অমিতাভ আইচ জানিয়েছেন, ওখানকার বহু এলাকা অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়ে তাতে নুনের ভাগ বেড়ে গিয়ে টাকের মতন হয়েছে। সেখানে কখনও সোয়েডা নামক এক প্রকার নোনা টক শাক ছাড়া কিছুই গজায় না। সুন্দরবনে প্রায় ৭০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ ও বাদাবনের প্রজাতির গাছ দেখতে পাওয়া যায় আর তার ৩৫টি হল প্রকৃত ম্যানগ্রোভ। এর মধ্যে অন্তত দুটো প্রজাতি এই লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে এ দেশের সুন্দরবন থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আর সে দুটি হল সুন্দরী (হেরিটিয়েরা ফোমিস) ও গোলপাতা (নিপা ফ্রুটিকানস)। অত্যাধিক ভাবে কমে গেছে সবচেয়ে ক্ষয়রোধী গর্জন (রাইজোফোরা), যা মূলত খাড়ির ধারে দেখা যায়। ধুঁধুল, পশুর (জাইলোকারপাস), এমনকি কাঁকড়া (ব্রুগয়রা), গরিয়া (ক্যানডেলিয়া ক্যানডেল)- এর মতো গাছ যথেষ্ট সংখ্যায় আর নেই।
সুন্দরবন উন্নয়নে আমি মনেকরি এই নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ কাটা এবং বেআইনি চিংড়ি ও মাছ চাষের জন্য মানুষই দায়ী। প্রশাসন শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিলে যদি কিছু হত।
জেলা পুলিশ ও প্রশাসন, মৎস্য, বন, সুন্দরবন রক্ষী কর্মীদের উন্নয়নের মতো সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের ফাঁক গলে চলছে সুন্দরবনের ধ্বংসলীলা। ম্যানগ্রোভ গাছ নয়। গাছের একটি প্রজাতি। এরা লবণাম্বু উদ্ভিদ। অর্থাৎ, যে জমিতে নুনের ভাগ বেশি, এরা সেখানে জীবনধারণ করতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য এই জাতীয় গাছের প্রজাতির বেশ কিছু অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য আছে। সমুদ্রের তীরবর্তী যে সব জমি দিনের অর্ধেক সময় জোয়ারের জলে ডুবে থাকে এবং বাকি সময়ে জল নেমে যায়, সেখানেই জন্মায় ম্যানগ্রোভ। সুন্দরবনেও তেমনই হয়। কথিত যে, সুন্দরবনের নাম একটি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ ‘সুন্দরী’ থেকে এসেছে। সুন্দরী ছাড়াও গর্জন, গেঁওয়া, বাইনের মতো লবণাম্বু উদ্ভিদ নিয়েই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এই প্রজাতি মাটি থেকে অতিরিক্ত নুন শোষণ করে তা পাতায় সঞ্চয় করে রাখে। নুনের পরিমাণ সম্পৃক্ত হয়ে গেলে সেই পাতা গাছ থেকে খসে পড়ে। এই ভাবে ম্যানগ্রোভ মাটিতে নুনের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। ম্যানগ্রোভের জঙ্গল যত ঘন থাকবে, তার প্রচণ্ড বেগের ঝড় বা প্রবল জলোচ্ছ্বাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা তত বাড়বে।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ছড়িয়েছে অসুখ। একটি অসুখ পুরোপুরি প্রাকৃতিক। অন্যটি মানুষের তৈরি। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বাড়ছে। তাতে উঁচু হচ্ছে ঢেউ। জলোচ্ছাসে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেই ঢেউ এসে পড়েছে সুন্দরবনেও। ওই সাতক্ষীরা ও খুলনার উপকূলের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল পুরোপুরি বিনষ্ট। তাই এই এলাকা দিয়ে জোরালো বাতাস চলে আসছে উপকূলের লোকালয় ছাড়িয়ে দেশের অন্য জেলাগুলোতে।
সব জানা সত্ত্বেও ম্যানগ্রোভের জঙ্গল কেটে লোকালয় তৈরির কাজ চলছে নদী সংলগ্ন কিছু অংশে। সুন্দরবনের গভীরতম এলাকার সুন্দরীর গাছের আকৃতি দেখলেই পরিষ্কার যে, গাছের ঘনত্ব বিপজ্জনক ভাবে কমছে। সুন্দরবন গবেষকরা বলেন উপগ্রহে চিত্রে সুন্দরবনের মাঝখানটা দেখলে মনে হবে টাক পড়ে গিয়েছে। আসলে মাটিতে অত্যাধিক নুনের উপস্থিতি সুন্দরী গাছের অভিযোজনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। গাছগুলি বেঁটে হয়ে গিয়েছে। ঝাঁকড়া হচ্ছে না। ঠেসমূলের বুনোটও জমাট হচ্ছে না। ঝড়ে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
ম্যানগ্রোভের এই অভিযোজন এবং ব্যাপক হারে ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হওয়ায় সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র বদলে যেতে বসেছে। খাদ্য-খাদক সকলেরই বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সঙ্কটে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারও। ম্যানগ্রোভ ধ্বংসে শুধুমাত্র যে উপকূল এলাকারই ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, বিপন্ন হচ্ছে পারশে, তোপসে, গুর্জালি, ট্যাংরা, খোলসে, ফলুইয়ের মতো বহু প্রজাতির দেশিয় মাছ৷ ওই এলাকায় পোনা ধরতে গিয়ে শুধুমাত্র যে বাগদার পোনাই ধরা হচ্ছে তাই নয়, নির্বিচারে ধরা পড়ছে দেশীয় ওই প্রজাতিগুলির মাছের চারাও৷ মানুষের এই কাজ-কারবারে ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে সুন্দরবনে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা দেশিয় এই মাছগুলি৷
সুন্দরবন উপকূলীয়, এলাকাগুলিতে ডিঙি নৌকা ব্যবহার করে নেট জাল দিয়ে মাছ এবং পোনা ধরার ওপর নির্ভরশীল আনুমানিক প্রায় এক লক্ষ প্রান্তিক মানুষ৷ জানাযায় সরকার যদি এই সমস্ত জেলে বাওয়ালী মানুষদেরকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন তাহলে সেই প্রবণতা অনেকটাই কমবে বলে মনে করি আমি৷ একই সঙ্গে বড় ট্রলারদের উপরও কিছু বিধিনিষেধ জারি এবং মৎস্যজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন তিনি৷
সুন্দরবন গবেষক অমিতাভ আইচ জানিয়েছেন, প্রায় ১৭৫ বছর আগে ইংরেজরা সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ইজারা দেয়, ভারতের মেদিনীপুর ও অধুনা, সহ কিছু এলাকার মনুষ। এছাড়া যশোর, খুলনা থেকে শত শত ভূমিহীন মানুষ সুন্দরবনে বসত গড়ে তোলেন। প্রথমেই তাঁরা যেটা করেন সেটা হল, ম্যানগ্রোভ জঙ্গল সাফ করে, যাবতীয় বন্য প্রাণীদের বিতারণ করা আর তারপর ভরা জোয়ার আর কোটালের জল যাতে দ্বীপে দিনে দু’বার ঢুকে পড়ে চাষবাস আর বসবাসের জমি ভাসিয়ে না দেয় তাই নদীর তীর বরাবর বাঁধ তৈরি করা হয়। এটার কারণ যেখানে তাঁরা বসত গড়েছিলেন সেই জায়গাগুলো কোনোদিনই মাটি ফেলে এত উঁচু করা হয়নি বা যায়নি যাতে জোয়ারের জল ঢোকা আটকানো যায়, আর নদীর নোনা জল ঢুকলে তো চাষাবাদ কিছু করা যাবে না, খাওয়ার জল পাওয়া, জীবন কাটানোই মুশকিল হবে। তাই যত দ্বীপে মানুষ বসবাস করতে শুরু করল,
ফল হয়েছে এই স্বাভাবিক জোয়ার ভাটায় পলি আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গল এলাকার তুলনায় এই মানুষের বসবাসকারী দ্বীপগুলো হয়ে গেল আরও নিচু, আর স্বাভাবিক জোয়ার ভাটার বাধা পাওয়ায় নদীখাতেও নানান বদল দেখা দেয়, কোথাও তা পাশের দিকে চওড়া হয়।
প্রতিদিন যে হারে গাছ কাটা হয়, তার ফলে ঝড়ের আঘাত এবার সরাসরি জনবসতিতে পড়তে শুরু করেছে ৷ ফলে ভয়াবহ বিপযর্য় ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা করেন উপকূলের বাসিন্দারা। এর মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে সুন্দরবনের বাঁধজনিত জটিলতা। উপকূলের সচেতন মহলের মানুষের দাবি “দরিদ্ররা যেন ঠিকমতো ত্রাণ পায়, দেখতে হবে। কেউ যেন বঞ্চিত না হয়। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারাই যে প্রতিদিন একটু একটু করে সুন্দরবনকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছেন, এই রূঢ় বাস্তবটা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দেখেন না, বা দেখলেও না বোঝার ভান করে। যেহেতু ওরা ভোটদাতা। বছরভর গাছ কেটে সাফ করে দিক ক্ষতি নেই, ভোটব্যাঙ্ক যেন অটুট থাকে। এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে ফরেস্ট অফিসার বনরক্ষীকর্মীদের তাহলেই সম্ভব, সচেতন হতে হবে আপনার আমার সকলকে। লেখক পরিচিতি : মোঃ আলফাত হোসেন, (সাংবাদিক) কৈখালী, শ্যামনগর,সাতক্ষীরা।