আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী…………………………………..
রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজার এলাকায় পথে পথে বেলুন নিয়ে ফেরি করে বেড়ায় ৮ বছর বয়সী ইসমাইল ইসলাম। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, কোর্ট এলাকার একটি বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ালেখা করে সে। পড়ালেখার পাশাপাশি কাজে নেমে পড়েছে পরিবারের টানাপোড়েনে। বাবার একার আয়ে চলছেনা ৫ সদস্যের সংসার। এতে লেখাপড়া বন্ধ হতে পারে যে কোনো সময়ে। তাই বাবার সাথে সংসারের ভার বহনের দায়িত্বে সেও শ্রমে লেগেছে। কখনো বেলুন কখনো বা হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করে সে।
এমনই আরেক শিশু ইব্রাহিম। ১২ বছর বয়সী ইব্রাহিম চাইলেও পড়ালেখার সুযোগ নেই। কাজ করছে হোটেলে। নেশার টানে বাবা কর্মহীন, মা বাসা বাড়িতে গৃহপরিচারিকায় নিয়োজিত। দ্রব্যমূল্য সহ সকল নিত্যপণ্যের এই উর্ধ্বগতির চাপে পড়ে মায়ের সামান্য আয়ে সংসার চালাতে হিমিশিম খেতে হতো। তাই পড়ালেখা ছেড়ে ইব্রাহিম যুক্ত হয়েছে হোটেল শ্রমে। এখানে খাবার বানানো থেকে শুরু করে হোটেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সব কাজই করে সবার সাথে।
সেচ্ছায় কাজ করো এমন প্রশ্নের জবাবে ইব্রাহিম জানায়, ‘সেচ্ছায় নয়, কাজ না করলে থাকা, খাওয়ায় অনেক কষ্ট হয়। মা অসুস্থ, বেশি কাজ করতে পারে না। আমি কাজ না করলে অনেক সময় না খেয়ে থাকা লাগে। তাই কাজে লেগেছি।
তানজিলা চৌধুরী : শিশুরা স্বভাবতই কোমলপ্রাণ। জাতীয় শিশু সনদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১৮ বছরের কমবয়সী সবাই শিশু। এই বয়সে তারা লেখাপড়া করবে, জগৎ সম্পর্কে জানবে-শিখবে, খেলাধুলা করবে এমনটা হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশে শিশুশ্রম যেন খুব স্বাভাবিক একটি প্রেক্ষাপট।
খেলার বয়সে নিন্মবিত্ত পরিবারের শিশুদের কাঁধেও চলে আসছে পরিবারের ভার বহন করার দায়িত্ব। কেউ লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু বাড়তি আয়ের জন্য কলম ছেড়ে হাতে নিয়েছে কড়াই, চামচ।
আমাদের দেশের শিশুশ্রমের পেছনে দারিদ্র্যতার পাশাপাশি অনেকটাই দায়ী শিক্ষাব্যবস্থাও। পারিবারিক টানাপোড়েন নিয়েও যেসব শিশুরা শিখতে আসে অনেক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পর্যাপ্ত সুবিধা না পেয়ে, লেখাপড়ার অতিরিক্ত ভার বহন না করতে পেরে তাদের পড়ালেখার অবসান ঘটে।
তাছাড়া বাবা-মায়ের শিক্ষার অভাব, অসচেতনতা, ঘরে সৎ মায়ের উৎপাত, বাবার নেশাগ্রস্ততা সহ বিভিন্ন কারণে অল্প বয়সেই কঠিন বাস্তবতার স্বীকার হতে হয় শিশুদের। তারা যুক্ত হয় হকারি, কুলিগিরি, ফুল বিক্রি, বেলুন বিক্রি, রিকশা চালনা, আবর্জনা সংগ্রহ, হোটেল শ্রম, ঝালাই কারখানার শ্রমে।
অনেকসময় এই কোমলপ্রাণেরা ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে মাদকদ্রব্য বহনের মত বিভিন্ন খারাপ কাজের সাথে। যা তাদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেকসময় তাদের অপরাধপ্রবণ করে তোলে।
এরকম হাজার হাজার শিশুরা আমাদের আশেপাশে রয়েছে খেলা ও শেখার বয়সে নানা রকম শ্রমে নিয়োজিত। তাদের প্রত্যেকের শ্রমের পেছনে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন হৃদয় বিদারক প্রেক্ষাপট।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও ইউনিসেফ পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০১ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুরা বিরামহীনভাবে শ্রম দিচ্ছে দিনের পর দিন। শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সব শ্রেণীর শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থের অভাবে যেন শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে কোনো শিশুকে ঝরে না পড়তে হয় সেজন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশুশ্রম আইন সংশোধন করে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে।
শিশুশ্রম বিষয়ে সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাষক আশরাফুল আলম বলেন, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এজন্য শ্রমজীবি শিশুদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন যাতে করে তারা অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারে। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর উচিত হবে এসব শ্রমজীবি শিশুদের চিহিৃত করে লেখাপড়ার জন্য বিশেষ সহায়তা প্রদান ও তাদের সুরক্ষার দিকে খেয়াল রাখা।#