মোঃ আলফাত হোসেন
সাধারণভাবে পরিবেশদূষণ নিয়ে আমরা যতটুকু কথা বলি, মাটিদূষণ নিয়ে তার কিঞ্চিৎ পরিমান ও করি না; যদিও মাটি সামগ্রিক পরিবেশেরই অংশ। মাটিদূষণ বর্তমান সময়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য। মাটির সঙ্গেই মিশে আছে আমাদের জীবন ও জীবিকা। কিন্তু আমরা অবলীলায় তাকে ধ্বংস করে ফেলছি।
জমিতে অত্যধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ মাটির যথাযথ গুণ নষ্ট করে ফেলছে। এই গুণ নষ্ট হওয়ার ফলে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। যেখানে সেখান ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন ফেলেও মাটির সর্বনাশ ঘটানো হচ্ছে।
শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি জমিতে ব্যাপক হারে ব্যবহার হচ্ছে কীটনাশক। কিন্তু কীটনাশকের ব্যবহারে মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। এর যথেচ্ছা ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি করছে, তেমনি কীটনাশক খেয়ে ফেলছে মাটির উর্বরতা শক্তি।একটি জরিপে জানা যায় বছরে কেবল কৃষি জমিতেই ব্যবহার করা হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার টন কীটনাশক। যার বড় একটি অংশ কোনো না কোনোভাবে যাচ্ছে মানব শরীরে। এতে মানুষ যেমন নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনি মারা যাচ্ছে সাপ, ব্যাঙ ও পাখিসহ নানা ধরনের প্রাণী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কীটনাশকের ব্যবহারের প্রয়োজন আছে, তবে তা নিয়ম মেনে এবং মাত্রার মধ্য থেকে ব্যবহার করা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে কীটনাশক ব্যবহারের কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না।
আর বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের এ নিয়ে নেই কোনো মাথাব্যথা,কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে বিশ্বের একজন ধনী ব্যবসায়ী, বিল গেইটস যিনি বর্তমানে কৃষিখাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী।
প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) তথ্য মতে, গত এক বছরের ব্যবধানে দেশে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ, পরিমাণে যা সাড়ে পাঁচ হাজার টন। চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর ও জার্মানি থেকেই আমদানি হয় পাঁচ ধরনের বালাইনাশক ও কীটনাশক।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ কীটনাশকের বিষাক্ততায় আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হয় কীটনাশকের কারণে। কিডনি রোগ, লিভারের রোগ, ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট বাড়ছে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে। কীটনাশকের প্রভাবে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মরা বাচ্চার জন্ম দেওয়া ও নবজাতকের মৃত্যু বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। তাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফসল উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রাকৃতিক জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং ফসলি জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে কৃষি খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার ড. এম মনজুরুল আলমের একটি গণমাধ্যমে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে বলেন, এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা হচ্ছে কৃষি যা এ মৃত্তিকা সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দেশের মৃত্তিকা আজ হুমকির সম্মুখীন। অধিক মাত্রায় কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারই এর প্রধান কারণ।
মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটির অস্তিত্ব পরিবর্তিত হয়ে অনুজীবের কার্যাবলি ব্যাহত হচ্ছে। এতে মাটির উৎপাদনশীলতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষক কী করবে? এ ক্ষেত্রে বক্তব্য হলো অধিক উৎপাদন পেতে হলে মাটির উর্বরতা শক্তি বজায় রাখতে হবে। জৈব পদার্থ হচ্ছে মাটির প্রাণ। জৈব সার গাছের খাদ্য ভান্ডার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যা দীর্ঘদিন ধরে গাছ ব্যবহার করতে পারে অর্থাৎ উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় সব পুষ্টি উপাদান জৈব পদার্থে বিদ্যমান। জৈব পদার্থ মাটিতে ব্যাকটেরিয়া তথা অনুজীবের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং গাছের পুষ্টি উপাদান গ্রহণের উপযুক্ত অবস্থা সৃষ্টি করে অর্থাৎ জৈব পদার্থ পুষ্টি উপাদানগুলোকে মাটিতে সহজলভ্য করে ও সুষম অনুপাতে থাকতে সহায়তা করে। সুতরাং কৃষিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বছরে যে ৪০ হাজার টন কীটনাশক আমদানি করা হচ্ছে তার ৬০ ভাগই ব্যবহার হয় ধান উৎপাদনে। যেটা কোনো না কোনোভাবে মানবদেহে প্রবেশ করছে। বর্তমানে দেশে ৮ ধরনের ২২৮টি মাকড়সানাশক, ৭৯ ধরনের ১০১৫টি ছত্রাকনাশক, ২৫৮৮ ধরনের কীটনাশক, ৫১ ধরনের ৬৯১টি আগাছানাশক, ২ ধরনের ১৩টি ইঁদুরনাশক, ৮৮ ধরনের ৭১৭টি জনস্বার্থ কীটনাশক রয়েছে। গুদামজাত শস্যেও পোকা দমনের জন্য ৪ ধরনের ৮৯টি কীটনাশক রয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ৫৩৫৯ ধরনের পেস্টিসাইড বাজারে সরবরাহ হয়। এগুলো কোনো রকম মনিটরিং ছাড়াই সর্বত্র বিক্রি হয়। সহজলভ্য হওয়ায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা অনায়াসে ফসল এবং খাদ্যদ্রব্যে এসব মেশান।
সম্প্রতি ন্যাশনাল ফুড সেপটি ল্যাবরেটরির (এনএফএসএল) নমুনা সংগ্রহ জরিপে রাজধানীসহ সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, কাপাসিয়া, গাজীপুর, কালিয়াকৈর, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীসহ কয়েকটি বাজারের ফুলকপি, বেগুন, শিম, লালশাকে মারাত্মক আকারে কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নমুনা পরীক্ষায় ২৭টি ফুলকপির মধ্যে ৮টিতে ম্যালাথিয়ন, ক্লোরোপাইরিফস, প্যারাথিয়ন মিথাইল ধরনের কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে।
এসব ফসলে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১৩ থেকে ২৬ গুণ পর্যন্ত বেশি বিষক্রিয়া রয়েছে। প্রতি কেজি ফুলকপিতে ২০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ম্যালথিয়ন সহনীয় মাত্রার হলেও পাওয়া গেছে ৭২৯ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। এ ছাড়া প্রতি কেজিতে ৫০ মিলিগ্রাম ক্লোরোপাইরফস সহনীয় হলেও বিদ্যমান আছে ১৬০৫ মিলিগ্রাম। বেগুনের ২৭টি নমুনার মধ্যে ১২টিতে ১৪ গুণ বেশি কুইনালফস উপাদান রয়েছে। প্রতি কেজি বেগুনে ১০ গ্রাম কুইনালফস সহনীয় হলেও ১২৪.২৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিদ্যমান আছে। পোকামাকড় মারার জন্য সহজ উপকরণ হিসেবে জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করছেন কৃষকরা।
দেশের শস্যক্ষেতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির ৬০৭টি পোকা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাত্র ২৩২টি বা ৩৮ শতাংশ পোকা ফসলের জন্য ক্ষতিকর। বাকি ৬২ শতাংশ পোকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ফসলের উপকার করে। এর মধ্যে ১৮৩টি বা ৩০ শতাংশ পোকা সরাসরি ফসলের জন্য উপকারী। আর ১৯২টি বা প্রায় ৩২ শতাংশ পোকা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে অথবা পরজীবী ও পরভোজী হিসেবে ফসলের উপকার করে। কিন্তু কীটনাশকের যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে উপকারী এসব পোকাও ধ্বংস হচ্ছে।
এ ছাড়া যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো মানুষের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে। বিশেষ করে শাকসবজিতে যেভাবে কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে, তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। শস্যের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গিয়ে ধীরে ধীরে শস্যকে অনিরাপদ করে তোলা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (বিসিপিএ) সূত্রে জানা গেছে, দেশে গত আট বছরে মোট ৪ লাখ ২২ হাজার ৬৬৬ টন বালাইনাশক ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে ইনসেকটিসাইডের পরিমাণ ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৬ টন, যা মোট ব্যবহৃত বালাইনাশকের প্রায় ৩৯ শতাংশ। দেশে মূলত তিন ধরনের ইনসেকটিসাইডস আমদানি করা হয় গ্র্যানুলার, লিকুইড ও পাউডার। গত আট বছরে ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৩১ দশমিক ৫৭ টন গ্র্যানুলার ইনসেকটিসাইড, ৩৬ হাজার ১০৯ দশমিক ৫০ টন লিকুইড ইনসেকটিসাইড ও ৯ হাজার ৪৯৫ দশমিক ৩৫ টন পাউডার ইনসেকটিসাইড ব্যবহার করা হয়েছে। কীটনাশক ব্যবহারেও কৃষি অফিসের নিয়মও মানছেন না কৃষকরা। সবুজ, হলুদ ও লাল এই তিন ধরনের কীটনাশক বাজারে পাওয়া যায়।
শাকসবজিতে পোকামাকড় আক্রমণ ঠেকাতে সবুজ কীটনাশক দেওয়ার নিয়ম। আর হলুদ কীটনাশক পোকামাকড় বা রোগবালাই বেশি হলে দিতে হয়। লাল রঙের কীটনাশক ধানক্ষেতের জন্য। কিন্তু দেখা যায় অসাধু ব্যবসায়ীরা লাল কীটনাশক শাকসবজিতে ব্যবহারের জন্য কৃষকদের কাছে বিক্রি করেন। কৃষকরা কৃষি অফিসের পরামর্শ না শুনে বিক্রেতাদের পরামর্শে শাকসবজির ক্ষেতে এসব ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে শাকসবজির নামে বাজার থেকে ক্রেতারা বিষ কিনে থাকেন। আর এসব খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হয় নানা জটিল রোগে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর পূর্ব কৈখালীতে আল-মামুন গাজী পেশায় একজন কৃষক তিনি জানান, গ্রামে আমাদের ঔষধের দোকান আছে সেখানে ঔষধ নিতে আসা প্রতিনিয়ত মানুষের পেটের অসুখ সহ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এমন দেখা যায়,এবং এই অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন তরিতরকারি বাজার হতে কিনে খেতে হয়, ২০২১ সাল হতে আমার ২০ শতক জমিতে আমি নানারকম শাকসবজি, তরিতরকারি চাষকরি সেটাতে কোনোরকম রাসায়নিক কীটনাশক,ইউরিয়া ব্যবহার করি না,আমি জৈব সার হিসেবে হাঁস-মুরগির পিষ্টা,গোবর ও কীটনাশক হিসেবে নিমপাতার নির্যাস,তুতে,তামাক,মেহগনির ফল, প্রয়োজনে এমন ধরনের কীটনাশক বা সার হিসেবে ব্যবহার করে আসছি এটাতে আমার চাষকৃত জমিতে যেটাই দিয়ে চাষ করি সেটাই ভালো ফলন পায় আমি মনে করি আমার জমির মাটির কোনো ক্ষতি হয় না।
অন্যদিকে আমার পরিবারে কোনোরকম অসুখ- বিসুখ নেই বললে চলে। তবে সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নজরদারি আর সকলের সচেতন সময়োপযোগী।# লেখক, মোঃ আলফাত হোসেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট।