স্মরণ সভায় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, শহীদ সাগরে গণহত্যার শিকার শহীদানসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদানদের রক্ত¯œাত বাংলাদেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের আতœদান সার্থক হয়েছে। আমরা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় সর্বদা শহীদানদের স্মরণ করি।
বর্তমান সরকার নর্থবেঙ্গল চিনিকলের তৎকালীন প্রশাসক লে. আনোয়ারুল আজিমকে স্বাধীনতা দিবস পদক প্রদান করেছে। শহীদ সাগরে হত্যাকান্ডের শিকার অন্যান্য শহীদানরাও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন। শহীদ সাগর প্রাঙ্গনকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে একটি কমপ্লেক্স নির্মাণ কার্যক্রমের পরিকল্পনা ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেছে বলে জানান এ আইন প্রণেতা।
বাসস জানায়, শহীদ সাগর দিবস উপলক্ষে নর্থ বেঙ্গল চিনিকল কর্তৃপক্ষ শহীদ সাগর প্রাঙ্গনে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্প স্তবক অর্পণ, স্মরণ সভা, কুরআনখানী এবং দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খয়ের উদ্দিন মোল্ল্যা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের এ দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী চিনিকল অবরুদ্ধ করে তৎকালীন প্রশাসকসহ ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। শহীদদের স্মরণে দিবসটি শহীদ সাগর দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী উত্তর বঙ্গের হেডকোয়ার্টার হিসেবে নাটোরে অবস্থান নেয়। ৫ মে সকালে তারা লালপুরের গোপালপুরে যাত্রা করে। চিনিকলের কাছাকাছি পৌঁছে গোপালপুর রেল ষ্টেশনের রেল ক্রসিং এ বাঁধার সম্মুখীন হয়। ষ্টেশনের পরিত্যক্ত ওয়াগন টেনে এনে রেল ক্রসিং এ ব্যারিকেড দেওয়া হয়। এ ব্যারিকেডের সাথে জড়িতদের হত্যার মাধ্যমে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। হানাদার বাহিনী নর্থ বেঙ্গল চিনিকল ঘিরে ফেলে। চিনিকলের সবগুলো গেটে তালা লাগিয়ে অবরুদ্ধ করে অবাঙ্গালিদের যোগসাজশে বাঙ্গালিদের শনাক্ত করে চিনিকলের এক নম্বর গেট সংলগ্ন পুকুর ঘাটে নিয়ে যায়। তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে লাশগুলো পুকুরে ফেলে দেয়। সেদিনের এ হত্যাযজ্ঞে কোন অবাঙ্গালি যাতে মারা না পড়ে সে জন্যে তাদের সবার মাথায় সাদা রুমাাল বাঁধা ছিল।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের নীরব স্বাক্ষী বুলেটবিদ্ধ হয়ে লাশের স্তুপের নিচে চাপা পড়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ছিলেন কয়েকজন। তাদের একজন এ চিনিকলের পাওয়ার হাউজের এসবিএ পদে চাকুরী করতেন খন্দকার জালাল আহমেদ। সদ্য প্রয়াত খন্দকার জালাল আহমেদের সাক্ষাৎকারে জানা যায় ঐদিনের ঘটনার বিবরণ। তিনি জানান, আনুমানিক সকাল সাড়ে দশটা। ডিউটি করছি। দুজন পাক সেনা আমার দুপাশে এসে দাঁড়ালো। একজন পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে বললো, ‘ইয়ে বাঙ্গালি চলো, মিটিং হোগা, মিটিং মে চলো’। এসময় মাথায় সাদা রুমাাল বাঁধা মঞ্জুর ইমান নামে একজন অবাঙ্গালি কর্মচারী বাঙ্গালিদের শনাক্ত করে দিচ্ছিল। এদিকে মিলের প্রশাসক আনোয়ারুল আজিমসহ অন্যান্যদের ধরে এনে মাটিতে বসিয়ে রাখে। একজন পাক অফিসার আজিম সাহেবকে লক্ষ্য করে বলে, ‘কিসনে মেজর আসলামকে মারা হায়’? তিনি বলেন, ‘জানিনা’।
নরপশুরা আমাদেরকে অফিসার্স কোয়ার্টারের পুকুর ঘাটে নিয়ে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। তখনই বুঝতে পারলাম, নিশ্চিত মারা যাচ্ছি। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘাতকদের ১৩ টি স্বয়ংক্রিয় এলএমজি এক সঙ্গে আমাদের ওপর গর্জে উঠে। গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাসে আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে পুকুর ঘাট লাশের স্তুপে পরিণত হয়। তাজা রক্তের স্রোতে রক্ত রাঙা হয়ে যায় পুকুরের পানি। নিথর নিস্তব্ধ হয়ে যায় প্রকৃতি। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে পুকুরের মধ্যে গড়িয়ে দেয় মরদেহগুলো। এক সময় জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি, আমার মাথাটা পুকুর ঘাটের সিড়ির ওপরে এবং শরীরের অর্ধেকটা রক্তে রঞ্জিত পানির মধ্যে ডুবে আছে। লাশের স্তুপের মধ্যে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে জীবন্ত কাউকে খুঁজে ফিরেেছ আমার এক সহকর্মী মেহমান আলী। বুঝলাম, তিনিই আমাকে লাশের স্তুপের মধ্যে থেকে উদ্ধার করেছেন। বহু কষ্টে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম, পাশে পড়ে আছে ছোট ভাই মান্নানের লাশ। সে বিভৎস দৃশ্যের কথা মনে হলে আজও শিউরে উঠি, গায়ে কাঁটা দিয়ে লোম খাড়া হয়ে উঠে।
শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শহীদ সাগর চত্বরে স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৫ মে চিনিকল চত্বরে স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন। স্মৃতি ফলকে ৪২ জন শহীদের নামের তালিকা লিপিবদ্ধ করা আছে। আনোয়ারুল আজিমের নামানুসারে গোপালপুর রেল স্টেশনের নামকরণ করা হয় আজিমনগর স্টেশন। মুক্তিযুদ্ধে আতœদানের স্বীকৃতি হিসেবে শহীদ আনোয়ারুল আজিমকে ২০১৮ সালে সরকার স্বাধীনতা পদক (মরনোত্তর) প্রদান করে। প্রতিবছর শহীদদের আতœীয়-স্বজন, চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় লোকজন ৫ মে শহীদ সাগর চত্বরে আতœ উৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে সমবেত হন।#