# আবুল কালাম আজাদ ……………………………………………
ডিজিটাল বাংলাদেশে সকল সেবা সহজতর। মানুষ ঘরে বসেই নিতে পারছেন সরকারি বহু সেবা। তবে এর ব্যতিক্রম যেন বাংলাদেশ রেলওয়ে! সম্প্রতি তাদের টিকিট কাটার পদ্ধতি আরও জটিল থেকে জটিলতার দিকে যাছে। রেল সংস্থাটি হাঁটছে সেবার পুরো উল্টো পথে!
রেলভবনে ১৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী টিকিট কালোবাজারির হাত থেকে ট্রেন যাত্রীদের মুক্ত করতে বেশকিছু নতুন উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান। এর মধ্যে অন্যতম টিকিট কাটার পদ্ধতি। যেখানে বলা হয়, ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’। অর্থাৎ, নিজ জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকিট কেটে ট্রেনে ভ্রমণ করতে হবে। অন্য কারো তথ্য ব্যবহার করে ভ্রমণ করলে বিনা টিকিটে যাতায়াত করছেন বলে তাকে অভিযুক্ত করা হবে। এরপর মুখোমুখি হতে হবে ভাড়াসহ জরিমানার। আগামী ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে এ সিদ্ধান্ত।
এখন প্রশ্ন ওঠেছে, যারা কালোবাজারি করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে কেন যাত্রীদের হয়রানি ও ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে? আর জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তে কালোবাজারি বন্ধ হবে কি না, সেটাও তো নিশ্চিত নয়!
রেলওয়ে সূত্র জানায়, অনলাইনে টিকিট ছাড়ার সাথে সাথে কালোবাজারিরা বিভিন্ন নামে টিকিট কেটে রাখে। পরে, ট্রেন ছাড়ার আগে তারা দ্বিগুণ দামে তা যাত্রীদের কাছে বিক্রি করে। অথচ যাত্রীরা অনলাইন বা স্টেশনের কাউন্টারে টিকিট পায় না। এতে রেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
এ ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে এবার মাঠে নেমেছে রেলওয়ে। যার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে টিকিট কাটতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র।
কিন্তু রেলের এ নতুন নিয়মে দেশের সব শ্রেণির নাগরিক চাইলেও ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবেন না। কারণ, নতুন নিয়মে আগে থেকে যাদের রেলের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করা আছে, তাদের সাইন ইন করে জন্ম নিবন্ধন সনদ আপলোড করে নতুন করে নিবন্ধন করতে হবে। আর যাদের আগে নিবন্ধন করা নেই, অর্থাৎ একেবারেই নতুন, তাদের প্রথমে ওয়েবসাইটে সাইন আপ করে জাতীয় পরিচয়পত্র আপলোড করে নিবন্ধন করতে হবে।
১২-১৮ বছর বয়সী যারা ট্রেনে ভ্রমণ করবেন, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তারা বাবা অথবা মায়ের এনআইডি দিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন। অথবা, নিজের জন্ম সনদ দিয়ে নিবন্ধন করে টিকিট কাটতে পারবেন। এছাড়া মোবাইল নম্বর থেকে এসএমএস পাঠিয়েও নিবন্ধন করা যাবে।
প্রক্রিয়ার এখানেই শেষ নয়, এ নিবন্ধনের জন্য সাইন আপ করতে একটি ই-মেইল আইডি লাগবে। অর্থাৎ, যারা ট্রেনে ভ্রমণ করবেন তাদের ই-মেইল এবং ইন্টারনেট সম্পর্কে অন্তত কিছুটা জানাশোনা থাকতে হবে। স্মার্টফোন বা কম্পিউটার চালনা জানতে হবে। আর কাউন্টার থেকে টিকিট কাটলেও আগে থেকে নিবন্ধন থাকতে হবে।
এ ব্যবস্থায় একটি এনআইডি বা জন্ম নিবন্ধন নম্বরের বিপরীতে ৪টি টিকিট কাটা যাবে। একটি নম্বর দিয়ে প্রতিদিন একবারই টিকিট কাটা যাবে। এছাড়া ভ্রমণকালে যাত্রীকে অবশ্যই নিজস্ব এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি অথবা পাসপোর্ট, ছবি সম্বলিত নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের যেসব নাগরিকের ইন্টারনেট সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞান নেই বা যে ব্যক্তি ই-মেইল কি তা জানেনা বা বুঝে না সে কীভাবে ট্রেনে ভ্রমণ করবে? তাহলে ট্রেন ভ্রমণ কী শুধু নির্দিষ্ট কিছু নাগরিকের জন্য সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে? অথচ আইন অনুযায়ী তো দেশের সব নাগরিকের ট্রেনে ভ্রমণের অধিকার রয়েছে।
আবার মোবাইল ফোনে এসএমএস-এর মাধ্যমে নিবন্ধন করে শুধুমাত্র কাউন্টার থেকে টিকিট কাটা যাবে। অনলাইন কিংবা অ্যাপের মাধ্যমে কাটা যাবে না। অথচ বর্তমানে রেলের অর্ধেক টিকিট অনলাইন ও অ্যাপে বিক্রি করা হয়। বাকি অর্ধেক কাউন্টার থেকে। যদিও রেলের সব টিকিট অনলাইনে বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। ফলে কারো কাছে মোবাইল না থাকলে তিনি ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারবেন না। জরুরি প্রয়োজনে কেউ ট্রেনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে চাইলেও থাকবে না সে সুযোগ। তখন রেলে ভ্রমণ করতে না পারা মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।
দেশের যেকোনো সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে নাগরিকদের হয়রানির অভিযোগ বহু পুরনো। যে কারণে অনেক সময়ই বলা হয়, সেবা খাতগুলো ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়া হোক। তাতে জবাবদিহি বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় তা বলে না– যার বড় উদাহরণ রেলের টিকিট কাটার পদ্ধতি!
এ বিষয়ে কথা হয় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একজন বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের সাথে। তিনিও বিষয়টিকে জটিল হিসেবেই আখ্যা দিলেন। তার মতে, দেশের সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না, বা সবসময় ইন্টারনেট কেনার সামর্থ্যও সবার থাকে না। সবার মোবাইল নেই, থাকলেও বিশেষ করে বয়স্করা কারো না কারো সাহায্য নিয়েই তা ব্যবহার করেন। ফলে তিনি জরুরি প্রয়োজনে টিকিট কাটতে পারবেন না। আর সেটি করতে হলেও তাকে অন্যের সাহায্য নিতে হবে। এতে এ কাজের বিনিময়ে তার কাছ থেকে সুযোগসন্ধানীরা আরও অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে। তিনি আরও প্রতারিত হতে পারেন।
বিষয়টি নিয়ে রেলেরও জেষ্ঠ্য ওই কর্মকর্তার কাছেও তেমন সমাধান পাওয়া গেল না। তবে তিনিও চান স্টেশনগুলো থেকে যে কেউ সহজেই যাতে টিকিট কাটতে পারে। সাথে এও জানালেন, স্টেশন এলাকায় কালোবাজারিদের কমবেশি সবাই চিনে। এদের নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। এজন্য রেলওয়ে পুলিশকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলে সাধারণ জনগণ ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে।
এবার একটু উন্নত বিশ্বের দিকে তাকানো যাক। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দেশগুলোতে কাউন্টারে কিংবা ভেন্ডিং মেশিন থেকে টিকিট কাটা যায়। এ ক্ষেত্রে গন্তেব্যের নির্ধারিত টাকা পরিশোধ করলেই চলে, কোন ব্যক্তিগত তথ্য কোথাও দিয়ে কাউকে ভেরিফায়েড করতে হয় না। আর অনলাইনে বা অ্যাপ দিয়েও টিকিট কেনা যায়। সেখানেও লাগে না এমন কোন ব্যক্তিগত তথ্য।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালে সেখানে দেখা যায়, রেলস্টেশনের আশপাশের নির্ধারিত দোকান থেকেও টিকিট কেনা যায়। এছাড়া অনলাইন সুবিধা তো আছেই। তারা আমাদের থেকে উন্নত দেশ, অথচ টিকিট কাটার ক্ষেত্রে তারা পদ্ধতি জটিল না করে সহজ করেছে। আর বাংলাদেশ দিন দিন জটিল করছে।
তবে, এর পেছনে কোনো গোষ্ঠীর লাভ আছে কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছন কেউ কেউ। তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, মানুষ টাকা দিয়ে টিকিট কেনে; হয়রানি বা ভোগান্তি কেউ চায় না। তাহলে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে রাষ্ট্র কী করছে?#