আবুল কালাম আজাদ………………………………………………………..
সাধারণভাবে যিনি সংবাদপত্রের জন্য সংবাদ সংগ্রহ করেন ও লিখেন তাকেই সাংবাদিক বলে অভিহিত করা হয়। তবে বর্তমান সময়ের আধুনিক সাংবাদিকতার বিশাল পরিসরে সাংবাদিককে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় বেঁধে দেওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়। এখন সংবাদপত্রের ধরনে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি সাংবাদিকদের কাজের পরিধিতেও পরিবর্তন এসেছে। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। ‘শতভাগ সঠিক সংবাদ প্রচারের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ ঘটনার সঠিক সংবাদ জানতে চায়। সত্য লুকানোর মধ্যে ঘটনার প্রতিকার হয় না। সঠিক ও সৎ সাংবাদিকতা সমাজ বদলে দিতে পারে।
প্রণয়নে অগ্রসর হন। তথ্যের একীকরণ সাংবাদিকের কাজেরই অংশ, যা কখনো কখনোরিপোর্টিং বা প্রতিবেদন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।
সততা একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় গুণ। অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকলেও সততার অভাবে অর্জিত সম্মান ধুলোয় মিশে যেতে পারে। যেহেতু গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়, তাই গণমাধ্যমকর্মীদেরও দর্পণের মতো স্বচ্ছ হতে হবে। এটা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার পড়ে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম কি গণমানুষের স্বার্থে কাজ করছে ? নাকি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের ব্যবসার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এমন প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে এসেছে৷
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠলে সাধারণত সরকারের নানা কালাকানুন, বিধিনিষেধ বা চাপের প্রতি ইঙ্গিত করেন অনেকে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথে বাধা কি কেবল সরকার? গণমাধ্যমের মালিক যারা- তারা নিজেরাও কি স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা সৃষ্টি করছেন না? বাংলাদেশের সম্পাদক এবং সাংবাদিকরা স্বীকার করছেন, গণমাধ্যমে বিগত দশকগুলোতে যে ধরণের পুঁজির লগ্নি হয়েছে, তাতে করে মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে এবং সাংবাদিকতার নয়, মালিকের স্বাধীনতার নিশ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুল ধারার গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটের অভিযোগ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
ঢাকার গুলশানে একজন কলেজ ছাত্রীর কথিত আত্নহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে যে মামলা হয়, মামলাটির খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে মুলধারার কিছু প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমে প্রথমে অভিযুক্ত বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
সেই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের ইস্যু আবারও আলোচনায় এসেছে। এই প্রবণতা উদ্বেগজনকহারে বেড়ে চলেছে বলে গণমাধ্যমের সাথে জড়িতদের অনেকে মনে করেন।
বাংলাদেশের মুলধারার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মানুষের আস্থার অভাবের অভিযোগ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের মুলধারার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মানুষের আস্থার অভাবের অভিযোগ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে সামাজিক মাধ্যমে।
ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতা বৃদ্ধির পেছনে বড় কারণ হিসাবে দেখেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে।
“সামগ্রিকভাবে আমাদের পেশাটা একটুখানি হুমকির মুখে। তারপর এই যে কোভিড এবং ডিজিটাল যে ট্রানজিশন-সব মিলিয়ে প্রিন্ট মিডিয়া বেশ কিছুভাবে আক্রান্ত বলা যেতে পারে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটা ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। যেখানে সঠিক এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা করা অত্যন্ত দুরহ ব্যাপার হয়ে গেছে” বলেন মাহফুজ আনাম।
মিডিয়া, বাংলাদেশ। যদিও বিভিন্ন সময় সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করার নানা অভিযোগ রয়েছে সাংবাদিকদের। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে যখন সরকারের স্বার্থ বা চাপ সৃষ্টির তেমন কোন বিষয় থাকে না, তখনও গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের অভিযোগ উঠছে। সেখানে মালিকের স্বার্থের প্রশ্নকে বড় কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন সাংবাদিক-সম্পাদকদের অনেকে।
সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেছেন, গণমাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ পুঁজি এবং কর্পোরেট হাউজের বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে।
তিনি মনে করেন, বিনিয়োগকারীদের অনেকে তাদের ব্যবসার স্বার্থে এবং অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতা বা রাজনৈতিক স্বার্থে গণমাধ্যমকে ঢাল হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেন।
“মালিকদের অনেকে ক্ষমতার অংশীদার। সেই মালিকরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে তার প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করছে। এটি ব্যবহার করতে যেয়ে সেলফ সেন্সরশিপটা চলে এসেছে এবং এক ধরনের কর্পোরেট সাংবাদিকতার মধ্যে চলে গেছে” বলে মন্তব্য করেন মোস্তফা ফিরোজ।
সাংবাদিকদের অনেকেই মনে করেন, গণমাধ্যমের চরিত্র এবং সংস্কৃতিই এখন বদলে যাচ্ছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক মুন্নী সাহা বলেছেন, নানা কারণে পেশাদারিত্বই হুমকির মুখে পড়েছে।
“আমাদের এখনকার অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা তারাই ভাল সম্পাদক বা ম্যানেজার, যারা ব্যবসায়িক স্বার্থটা ঠিক করে সেন্স করতে পারি, মালিকের স্বার্থটা ঠিকভাবে সেন্স করতে পারি। এছাড়া সরকারের অহেতুক খবরদারি থাকে অনেক সময়, সেগুলো যারা সেন্স করতে পারি, তারাই এখন ভাল সাংবাদিক” বলেন মুন্নী সাহা।
তিনি আরও বলেন, “কী করবো বা কী করবো না- সেটাও একেক সময় একেকভাবে প্রকাশিত হয়। আগ বাড়িয়ে কিন্তু আমরা এখন আর সাংবাদিকতা করতে পারি না।
সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সাংবাদিকদের অনেকেই যখন প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকেই চাপের অভিযোগ করেছেন, সেই অভিযোগের ব্যাপারে একাধিক মালিক সম্পাদকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কথা বলতে রাজি হননি।
সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের একজন নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এখন একটি ইংরেজী দৈনিকের মালিক সম্পাদক। তিনি বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজেরও অন্যতম একজন মালিক।
তিনিও বলেছেন, এখন মালিকদের স্বাধীনতা রয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতা নেই সাংবাদিকের। “কর্পোরেট হাউজগুলোর এখন মিডিয়ার মালিক হওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।”
“আমাদের এখানে নতুন যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে, কর্পোরেট গোষ্ঠীর মালিকানার যে হাউজগুলো, সেখানেও একটা বিভক্তি দেখা যায়। কখনও কখনও এক হাউজ আরেক হাউজকে তাদের ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থে আঘাত হানছে, সেখানে কিন্তু কর্মরত সাংবাদিকরা অংশীদার হয়ে যাচ্ছেন। এটি কিন্তু সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার বিপরীত” বলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী। অন্যদিকে দলীয় বিবেচনায় বা রাজনৈতিক কারণে সাংবাদিকদের ইউনিয়নগুলোও বিভক্ত।
সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকছে না বলে মনে করছেন সাংবাদিকদের অনেকেই।#