# আবুল কালাম আজাদ……………………………..
প্রমত্তা যমুনার বুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু এখন দৃশ্যমান। ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকের এ রেল সেতুর ৪৭ ও ৪৮ নম্বর পিলারের উপর বসেছে প্রথম স্টিল স্ট্রাকচার স্প্যান। শিগগিরই বসবে আরও ছয়টি। শুধু স্প্যান বসানোই নয়, অন্য কাজও চলছে দ্রুতগতিতে। রাত-দিন সেতুর ৫০ পিলারের মধ্যে আটটি স্প্যান বসানোর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত, শেষের পথে আরও কয়েকটি। চার দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ সেতুটি চালু হলে উত্তরাঞ্চলে রেল যোগাযোগে নবদিগন্তের সূচনা হবে। তাই উচ্ছ্বসিত এ অঞ্চলের মানুষ। খুশি যমুনার দুপারের বাসিন্দারাও। সেতুটি খুলে দেওয়া হলে ১০০ থেকে ১২০ কি:ম: গতিতে চলবে ট্রেন।
রোববার প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সেতুকে ঘিরে যমুনা নদীর দুই প্রান্তে (সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল) চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। টুংটাং শব্দে মুখর এ এলাকা। বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতুর ৩শ’ মিটার উজানে নদীতে সারি সারি বসানো নানা যন্ত্রপাতি চলছে অবিরাম। সেতুর পূর্বপ্রান্তে ৪৭ ও ৪৮ নম্বর পিলারের উপর স্প্যান বসেছে। দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও শ্রমিক ব্যস্ত নানা কাজে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের মার্চে এ সেতুর পিলারের পাইলিং শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ৫০ পিলারের মধ্যে ৩৪টির কাজ চলমান রয়েছে। নতুন প্রযুক্তির লোহা আর কংক্রিটের সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে এ সেতু।
১৯ আগস্ট প্রথম স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হয়। ২ সেপ্টেম্বর স্প্যানটি বসলেও এর কারিগরি অন্যান্য কাজ শেষ করতে মাসের এ কটা দিন কেটে যাবে। এরপরই আরও ছয়টি স্প্যান বসানো হবে। সেগুলো এরইমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। স্টিল স্ট্রাকচার অত্যাধুনিক স্প্যানে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে তাতে আলাদাভাবে রং করার প্রয়োজন হবে না। এটি হবে টেকসইও। আগামী ১০০ বছরেও সেতুর কাঠামোয় মরিচা ধরবে না। আবহাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে গার্ডারের রংও।
সূত্র জানায়, সেতুর দুই প্রান্তে প্রথম তিনটি পিলার বসেছে ২৫০ মিটারের মধ্যে। অন্য পিলারগুলো বসছে ১০০ মিটার পরপর। দুই পিলারের মধ্যবর্তী দূরত্বের ফারাকের কারণে অন্য সেতুর মতো পিলার থেকে পিলার স্প্যান বসছে না। এক স্প্যানের সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হবে নদীর অংশেই। ২০২৪ সালে সেতুর কাজ শেষ হবে।
১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ শুরু হয়। তবে ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ফাটল দেখা দেওয়ায় কমিয়ে দেওয়া হয় ট্রেনের গতি। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩৮টি ট্রেন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে পারাপার হওয়ায় সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি ঘটছে শিডিউল বিপর্যয়। বাড়ছে যাত্রী ভোগান্তি। এমন সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর উপর আলাদা রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুটির নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে রেল সেতু প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করছে জাইকা। রেল সেতুটি খুলে দিলে মানুষের সহজ যাতায়াত যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি খুলবে উত্তর জনপদের ব্যবসা-বাণিজ্যে, তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা। সেতুর পশ্চিমপাড়ে গড়ে উঠছে সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন ও বিসিক শিল্প পার্ক।
জোনের পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সেতুটির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলায় খুশি ব্যবসায়ীরাও। অল্প খরচে ট্রেনে উত্তরাঞ্চল থেকে সারা দেশে সরাসরি কৃষি ও শিল্প পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন ও বিসিক শিল্প পার্কে উৎপাদিত পণ্য সহজে ট্রেনে পরিবহণ করা যাবে দেশ-বিদেশে। সিরাজগঞ্জ চেম্বার অ্যান্ড কমার্সের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ সূর্য বলেন, রেল সেতুটি চালু হলে রাজধানীর সঙ্গে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। এতে যাত্রীসেবার মান বাড়ার পাশাপাশি ভারত থেকে সরাসরি ঢাকায় ট্রেনে পণ্য পরিবহণ করা যাবে।
এ ছাড়া কয়েকটি দেশে পণ্য পরিবহণ সহজ হবে, কমে আসবে আমদানি-রপ্তানি খরচ। পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর পর দেশের রেল যোগাযোগে এক নতুন মাত্রা যোগ করতে যমুনার বুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। সেতুটি নির্মাণ হলে দেশের রেল যোগাযোগ সমৃদ্ধ হবে। উত্তরবঙ্গের বহু মানুষ নির্বিঘ্নে রেলপথে বাড়ি থেকে রাজধানীতে দৈনন্দিন যাতায়াত করেই পেশাগত কাজ করতে পারবেন। ফলে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ রেলসেতু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ৫০টি পিলার আর ৪৯টি স্প্যানে তৈরি হচ্ছে এ রেলসেতু। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর এ সেতুর কাজ ইতোমধ্যে প্রায় ৪৫ ভাগ শেষ হয়েছে। সেতুটি চালু হলে ডাবল লাইনে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে দিনে অন্তত ৮৮টি ট্রেন চলাচল করতে পারবে।#