‘‘কোনদিন যাবে না ভোলা’’ (ছোটবেলার মধুময় স্মৃতি: )
…………………………………..মুনীর চৌধুরী সোহেল
খুলনা জেলাধীন তেরখাদা উপজেলায় মুনীর চৌধুরী সোহেলের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত হয়। শৈশব থেকে কৈশোর এবং যৌবনে পদার্পণের মুহূর্ত পর্যন্ত মুনীর চৌধুরী সোহেল তেরখাদায় অবস্থান করেন। মুনীর চৌধুরীর কাছে স্পষ্টত মনে হয় গ্রাম ও শহরের জীবনযাপনের মান ও স্মৃতির মধুময়তার মধ্যে ঢের পার্থক্য আছে।শহরে থেকে ছোটবেলার স্মৃতি যত না মধুময় গ্রামে ছোটবেলার স্মৃতি তার চেয়ে বেশি মধুময়।
সবেমাত্র চোখ ফুটেছে আমার। তখনও আমি পৃথিবীকে চিনতে শুরু করিনি।
আমার পাশে থাকা মানুষকে কেবল সামান্য চিনতে শুরু করেছি, এরকম অবস্থায় তেরখাদায় আমার আগমন।
সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ১৯৭৫ সালে জন্মের ৬ মাস বয়সে আমি আমার আম্মার সাথে তেরখাদায় যাই। আমার প্রয়াত পিতা হেমায়েত হোসেন চৌধুরী ও মাতা সুলতানা রেবেকা বেগম দু ‘জনই শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। দু’জনে শিক্ষক হিসেবে চাকুরী পাবার সুবাদে আমার তেরখাদায় যাবার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
শৈশব থেকেই আমি বহুজনকে চেনার চেষ্টা করি। তেরখাদায় বেড়ে ওঠার সাথে সাথে অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়, এদের মধ্যে কারো কারো সাথে বন্ধুত্ব হয়।
বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আমার সাথে পড়াশোনা করেছে। সহপাঠী হিসেবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এক সাথে পড়েছি। এদের প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধু বলার প্রশ্নই ওঠে না। অপ্রাতিষ্ঠানিক বন্ধু বলা যুক্তিযুক্ত ও শ্রেয় হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক বন্ধুই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধু। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক ও বাণিজ্যিক বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকে নিষ্প্রাণ। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে রয়েছে তেরখাদা উপজেলাধীন বারাসাত গ্রামের অধিবাসী ডাঃ এনামুল হক, এস এম নূরুজ্জামান, পশ্চিম কাটেঙ্গা গ্রামের অধিবাসী মোঃ শরিফুল ইসলাম শরিফ, মোঃ ফারুক শিকদার, বেলফুলিয়া কাটেঙ্গা গ্রামের অধিবাসী আব্দুল্লাহ আল মাসুম, মোঃ নেছার আলী মাহমুদ, কাটেঙ্গা গ্রামের অধিবাসী এস,এম, শহীদুল্লাহ তুহিন (লন্ডন প্রবাসী), কলেজ শিক্ষক মোঃ হিমরুল ইসলাম, মোঃ ইমদাদুল হক (ইমদাদ), মোল্লা নাসির উদ্দীন, মোঃ ওবায়দুল ইসলাম চুন্নু, দিলরুবা হাসনা, জয়সেনা গ্রামের অধিবাসী স্কুল শিক্ষক মোঃ আসলাম মোল্লা, আটলিয়া গ্রামের অধিবাসী এস এম সেলিম আহমেদ, রামমাঝি গ্রামের অধিবাসী মোঃ হাবিবুর রহমান হাবিব, তেরখাদা গ্রামের অধিবাসী নিলুফা ইয়াসমিন জুঁই, স্কুল শিক্ষক সরদার নবীর হোসেন, সরদার কবীর হোসেন, পাপিয়া চৌধুরী রিনি, ফারজানা চৌধুরী ডলি, ডাঃ সুধাংশু কুমার বিশ্বাস, মনিরুজ্জামান শেখ, স্কুল শিক্ষক মোঃ আবুল হাসান সরদার, মধুমঙ্গল বিশ্বাস, মিহির কুমার মদ্দম, আবদুর রাজ্জাক কচি, স্কুল শিক্ষক লিপিকা পাত্র, বিশ্বজিৎ সাহা (কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), প্রয়াত দীপঙ্কর সাহা (কলকাতা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) সদ্য প্রয়াত শ্যামলী সাহা (বৈবাহিকসূত্রে তার শ্বশুরবাড়ী পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), বিগত দুই বছর দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে সম্প্রতি মৃত্যুবরণ করে। ইখড়ী গ্রামের অধিবাসী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) এস এম সাজ্জাদুল কবীর, মোল্লা মোঃ দেলোয়ার হোসেন, মোঃ বিল্লাল শেখ, মোঃ দুল মিয়া, নেবুদিয়া গ্রামের অধিবাসী এস এম বখতিয়ার রহমান, কলেজ শিক্ষক মোঃ মঞ্জুরুল আলম, নাচুনিয়া গ্রামের অধিবাসী বিএম মিরাজ হোসেন, মসুন্দিয়া গ্রামের অধিবাসী এস এম আলমগীর হোসেন (আলম) প্রমুখ।
এছাড়া অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা বন্ধুরা হলো, খুলনা জেলার রূপসা উপজেলাধীন দেয়াড়া (যুগিহাটি) গ্রামের অধিবাসী মাহমুদ রেজা আলম রিপন, আহমেদ সুজা আলম সুমন (ফ্রান্স প্রবাসী), পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার অধিবাসী মোঃ হুমায়ুন কবীর (টিটো), কুমিল্লা জেলার উত্তর চর্থা গ্রামের জান্নাতুল ফেরদৌস পাপিয়া, রাজীব রাহা হৃত্তিক অন্যতম। তেরখাদায় সরকারি চাকুরির সুবাদে অনেক কর্মকর্তার পুত্র কন্যা আমাদের সাথে পড়েছে। এদের মধ্যে অনেকে আছে যাদের আজ পর্যন্ত ভুলতে পারিনি। তাদের মধ্যে স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে হৃত্তিক এর নামটি। সে অনেকের মধ্যে অন্যতম বন্ধু। তার বাবা অপূর্ব রাহা তেরখাদা টিএনও কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন,আমার পিতা হেমায়েত হোসেন চৌধুরীর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
১৯৮৩ সালের কথা। প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধু হিসেবে হৃত্তিক যুক্ত হয়। আস্তে আস্তে হৃত্তিকের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। তখন আমরা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের ইংরেজি পড়াতেন শ্রীপতি মজুমদার (শ্রীপতি স্যার)। বহু আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। গল্প বা কবিতা পড়া দিলে সেই পড়া না পারলে শাস্তি থেকে কোনভাবেই রেহাই পেতাম না। কোন কারণ দর্শিয়ে পড়া না পারার অজুহাত মানতেন না। বেত্রাঘাত থেকে কারো মাফ ছিল না। একদিন আমি আমার পিতামাতাসহ খুলনায় নানী বাড়ী বেড়াতে আসি। খুলনায় বেড়িয়ে কয়েকদিন পর তেরখাদায় ফিরে যাই। স্কুলে যেয়ে বন্ধুদের শরণাপন্ন হই। জিজ্ঞাসা করি আজ কোন ইংরেজি পড়া আছে কিনা ? পড়া দিয়ে থাকলে ইংরেজি গল্প বা কবিতার নাম কি ? কবিতাটির নাম জেনেই আমি বললাম- টিফিন এর সময় আমি পড়ে নেব। ক্লাস যখন শুরু হলো তখনও হৃত্তিক এসে পৌঁছায়নি। হৃত্তিক কেন আজ আসেনি এই কথা বলতেই অন্য বন্ধুরা বলল- দু’দিন আগে ইংরেজি স্যারের পড়া পারেনি। প্রচন্ড মার খেয়েছে। গত দু’দিন ধরে স্কুলে আসছে না। অনুমান করে আমি বলে বসলাম- হয়ত ভয় পেয়ে হৃত্তিকের খুব জ্বর হয়েছে। অন্যদিকে পড়া মুখস্ত হয়নি, সেজন্য আজ স্কুলে আসছে না। আমরা ঠিক করলাম টিফিন এর সময় হৃত্তিকের বাসায় যাব। টিফিনের ঘন্টা বাজতেই আমরা বন্ধুর বাসায় যাবার জন্য অগ্রসর হই। স্কুল সংলগ্ন মাঠ।
আর মাঠ পেরিয়ে রাস্তা। মাঠ থেকে একটু অগ্রসর হতেই দেখি হৃত্তিক আসছে। আনন্দে বলেই উঠি, ঐ দ্যাখ হৃত্তিক আসছে। তখনও পর্যন্ত হৃত্তিকের মুখ অন্য বন্ধুদের চোখে পড়েনি। হৃত্তিকের চেহারাটি আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হলে তখন বুঝতে পারল বন্ধুটি আসছে। হৃত্তিক কাছে আসতেই বলে বসলো- সেদিন ইংরেজি পড়া না পারাতে শ্রীপতি স্যার আমাকে বেত্রাঘাত করেন। তাই ভয়ে আমার জ্বর চলে আসে। আজ জ্বর অনেকটা কম। আজ ইংরেজি পড়া কোনটা দিয়েছে। টিফিনের এই সময়টার মধ্যে মুখস্ত করে ফেলব। টিফিনের সময় অতিবাহিত হবার আগেই আমাদের পড়া শেষ। দু’জনের পড়া বেশ মুখস্ত হয়ে যায়। টিফিনের সময় শেষ হলেই ইংরেজি ক্লাস শুরু হয়। শ্রীপতি স্যার আমাদের দু’জনকে পড়া ধরলেন। দু’জনেই পরিচ্ছন্নভাবে পড়া পারলাম। কবিতা পাঠ সুন্দরভাবে পারার কারণে দুজনকে এমনভাবে পিঠ চামড়ালেন, তখন আমাদের কাছে মনে হলো, পিঠ চাপড়ানোর চেয়ে বেত্রাঘাত খাওয়া ঢের ভালো ছিল। গ্রামের আনন্দ-বিনোদনের পাশাপাশি আমরা নিষ্ঠার সাথে পড়াশোনা করে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠি।
তখন ১৯৮৫ সাল। এ সময় সরকারী চাকুরীর সুবাদে সহকারী কমিশনার (ভ.মি) এর কন্যা প্রভাবতী আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধু হিসেবে যুক্ত হয়। পঞ্চম শ্রেণীতে বাংলা বিষয় পড়াতেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শেখ আমীর হোসেন স্যার। যখন বাংলা কবিতা মেয়ে বন্ধুদের ধরতেন তখন খুবই নিচু কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পেত। ফলে শুধু আমীর স্যার কেন, আমরাও স্পষ্ট শুনতে পেতাম না। আমীর স্যার তখন হাস্যোচ্ছলে বলেই বসলেন- তোদের গলায় কী কিছু বিধেছে যে, গলা দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না? আমরাও ছেড়ে দেবার পাত্র নই। মেয়ে বন্ধুদের চটাতে আমরাও স্যারকে বললাম- প্রভাবতী ও হাসনা কবিতাটি ভালো করে পড়ে আসেনি, তাই এখন আর উঁচু ও পরিস্কার কণ্ঠে পড়া দিতে পারছে না। অথচ আপনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে হর্ষধ্বনি দিয়ে মাঠে যাবে, তেঁতুল গাছে চড়বে। তারাও কম যায় না, তারাও হারবার পাত্রী নয়। সাথে সাথে অস্বীকার করে বসলো-না, না স্যার, একেবারেই সত্য নয়। ঘন্টা পড়ে গেল। আমীর স্যার শিক্ষক কক্ষে চলে গেলেন। প্রভাবতী ও হাসনা আমাদের এক প্রকারে ঘেরাও করলো। বললো- পড়া তো আমরা পারি, কিন্তু স্বভাবতই নিচুস্বরে কথা বলি। এ কারণেই অন্য কেউ আমাদের পড়া শুনতে পারে না। আমরা একে অপরের বন্ধু। আমাদের বিপক্ষে যাবি কেন? তারা আমাদের ওপর বেশ রুষ্ঠ হলো। নিজেরাই অঙ্গীকার করলো- আমাদের সঙ্গে কথা বলবে না। ক্লাস থেকে লিপি, প্রভাবতী ও হাসনা বেরিয়ে গেল। তারা যাতে আমাদের না দেখে সেজন্য আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় এর কলা গাছ বাগানের পেছনে চলে যাই। মাহমুদ, মাসুম এবং আমি লুকিয়ে থাকি। আমাদের মাঠে না দেখতে পেয়ে ওরা তিনজন তেঁতুল গাছের দিকে আস্তে আস্তে যেতে লাগলো। তেঁতুল গাছ তলায় যেয়ে প্রভাবতী হাসনার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের অবস্থান কোথায়? তা’ যাতে ভালো করে দেখে। হাসনা চড়ান্ত ভরসা দিলে প্রভাবতী তেঁতুল গাছের প্রায় মগডালে উঠে যায়। প্রভাবতী গাছতলায় তেঁতুল ফেলছে, আর লিপি তেঁতুল সংগ্রহ করছে। টপাটপ তেঁতুল পড়ছে, হাসনাও তেঁতুল কুড়াচ্ছে। এই পরিবেশটা আমাদের জন্য মোক্ষম।
এবার আমরা তেঁতুল গাছতলায় হাজির। শুধুমাত্র মাসুম তেঁতুল গাছতলায় অনুপস্থিত থাকলো। কারণ, মাসুম হচ্ছে হাসনার আপন মামা। ফলে ভাগ্নী ক্ষেপে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ঘটনার আড়ালে নিজেকে রেখে দিল। মেয়ে বন্ধুরা বুঝতেই পারেনি যে, আমরা এভাবে হাজির হবো। চৌকি দেওয়ার ক্ষেত্রে হাসনার অদক্ষতার পরিচয় এর জন্য প্রভাবতী বেশ রুষ্ঠ হয়। পরিশেষে তারা তেঁতুল পাড়ার ঘটনাটি প্রকাশ না করতে আমাদের অনুরোধ করে। তাদের অভিমত, এ ঘটনাটি স্যারদের কানে যাতে না যায়। আমরাও শর্ত জুড়ে দেই- বন্ধু হিসেবে কথা বন্ধ করে দিলে আমরাও স্যারদের কাছে ঘটনাটি প্রকাশ করে দেব। ফলে উপায়ন্তর না দেখে তারা যে, বন্ধুত্বের অসন্তুষ্টির চিড় ধরিয়েছিল আবার তারাই তা উঠিয়ে নিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে আমরা সবেমাত্র মাধ্যমিকে উঠেছি। আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির নাম ইখড়ী কাটেংগা ফজলুল হক পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
৫বছর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই বিদ্যালয়টিকে সরকারীকরণ করা হয়। ১৯৮৬ সালের কথা। তখন আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন মিহির কবিতা পাঠ করে আমাদের আনন্দ দিত। পঠিত কবিতাগুলো তার নিজের রচনা ছিল না। অন্যের কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দিত। আমাদের আনন্দে ভরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে অত্যন্ত সরল মনে এ কাজটি করত। এ অনাবিল আনন্দের মধ্যে কোন কপটতা ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণীতে গণিত বিষয় পড়াচ্ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রতন কুমার দাস। ক্লাস চলাকালীন মিহির রতন স্যারের কাছে যেয়ে বলল- স্যার আমি একটি কবিতা লিখেছি। কবিতাটির নাম-ধামা ধরার দেশ।
রতন স্যার অবাক নেত্রে তাকিয়ে থেকে বললেন- কবিতাটি পাঠ কর তো। মিহির কবিতাটি পাঠ করা শুরু করলো। কবিতা পাঠের সমাপ্তি ঘটলে মিহিরকে সকলে প্রশংসা করলো। মিহির হলো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সহপাঠীরা হর্ষধ্বনি দিল। রতন স্যার খুব গর্ববোধ করলেন। মিহির একজন অজপাড়াগাঁ এর ছেলে। পড়াশোনার চেয়ে ফাজলামীতে বেশ ওস্তাদ। তার মধ্যে এই প্রতিভা। রতন স্যার আগ্রহের সাথে কবিতাটি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক ও আমাদের পিতা প্রয়াত হেমায়েত হোসেন চৌধুরীর নিকট হস্তান্তর করেন। আমার পিতাও কবিতাটি মিহিরকে পুনরায় পড়তে বলেন। সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সম্মুখে মিহির কবিতাটি পাঠ করে। কবিতা পাঠ শেষে আমার আব্বুসহ শ্রদ্ধেয় সকল শিক্ষক ভয়সী প্রশংসা করেন। আব্বু কবিতাটি বাসায় এনে খুবই যত্নের সাথে রাখেন। কিছুদিন পর মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ডাকঘরে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রয়াত শান্তি রঞ্জন বিশ্বাস (শান্তি স্যার) এবং আমি বসে আছি। স্যার আমাকে বললেন সোহেল, ‘ধামা ধরার দেশ’ কবিতাটি খুবই সুন্দর হয়েছে।
আমি মাথা নাড়লাম। তেমন কিছু বললাম না। আমার সামনে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ছিল। আমি পত্রিকাটি পড়তে লাগলাম। সংবাদপত্রটির ৪/৫ টি পাতা উল্টিয়ে খবর পড়ার সময় চোখে পড়ল ২/৩টি কবিতা। কবিতার শিরোনামের দিকে চোখ পড়তেই দেখি মিহিরের লেখা ঐ কবিতাটি। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে কবিতাটি ছাপার জন্য আমি হতবাক হলাম। শিরোনামটি পড়ার পরেই কবি’র নামটি পড়লাম। কবি’র নাম মিহির কান্তি রাউত। নামটি ছাপা অক্ষরে জ্বল জ্বল করছে। তৎক্ষণাৎ আমি শান্তি স্যারের কাছে যাই। স্যার কে বললাম- ঐ লেখাটি মিহিরের নয়। আমার কথা শুনে শান্তি স্যার অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার কথা স্যার মেনে নিতে পারলেন না। সামান্য সময় এর মধ্যে স্যার আমাকে বললেন- মিহিরের যে লেখা নয় তার প্রমাণ কী? তুমি তার প্রমাণ দিতে পারবে? স্যার পারবো। প্রমাণ হিসেবে আমি পত্রিকাটি দেখালাম। স্যার ছাপাকৃত কবিতাটি পড়লেন,পড়েই স্যার বললেন- সোহেল, দু’জনের কবিতাটি হুবহু এক।
এটা কী করে সম্ভব? আমি বললাম- এই কবিতাটির মূল রচনাকারী হচ্ছেন মিহির কান্তি রাউত। স্যার কবি’র নামটি পড়ে বললেন- তাইতো, নামের সাথে মিল নেই। অথচ কবিতাটি তার নিজের বলে চালিয়ে দিল। আচ্ছা সোহেল, সংবাদপত্রে এই কবিতা ছাপা হয়েছে, তা তুমি কি করে জানলে? উত্তরে জানালাম- স্যার আমি নিজেই জানতাম না। পত্রিকা পড়তে যেয়েই এ বিষয়টি আমার চোখে পড়েছে। তারপর পানি যতদূর গড়াবার তা’ গড়ালো। মিহিরকে ডাকা হলো। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো- এমন কাজটি কেন করল? মিহিরের সহজ-সরল উত্তর, বন্ধুদের আনন্দ দেবার উদ্দেশ্যে আমার এই পথ অবলম্বন করা। আমার কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। তার মধ্যে অন্যায় বা অপরাধবোধের ছাপ চোখে পড়েনি। তবুও শিক্ষকেরা বললেন- আনন্দের মধ্যে কলুষতা থাকে না এটা সত্য। কিন্তু এই নির্মল আনন্দ দিতে যেয়ে অন্যের কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া বড় অন্যায়। কারণ প্রকৃত কবি’র সাথে করা হয় প্রবঞ্চনা। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণীতে উঠতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি।
সপ্তমেও আমাদের গণিত পড়াতেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রতন কুমার দাস,আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম মধুমঙ্গল।
বন্ধু সুধাংশু’র আপন ভাই সে খুবই সহজ-সরল, অনেক ক্ষেত্রে বহু কথা অকপটে প্রকাশ করে ফেলে।
লপড়াশোনার প্রতি একটু ঝোক কম,ফলে পড়াশোনা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য রতন স্যার মধুকে উদ্দেশ্যে করে বলতেন, ভাত খেয়ে যা’ মধুমঙ্গল, ভাত খাইয়ে যা’ মইধ। অর্থাৎ এই উক্তির উদ্দেশ্য হলো- পড়াশোনা করে মানুষ হতে পারলে, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উঁচু অবস্থানে যেতে পারলে, মা-ও ভালো চোখে দেখে,তখন সন্তানের নামটিও সঠিকভাবে বলেন।
শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করেন। এভাবে মন্তব্য করেন স্যার রতন কুমার দাস,বন্ধুত্বের অপার সম্পর্ক থাকে নিস্কলুষমুক্ত,থাকে নিখাদ সম্পর্ক,বর্তমানে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ দূরে-বহুদূরে থাকলেও, এমন কি প্রবাসে বসবাস করলেও, পেশাগত কাজের ভীড়ে মগ্ন থাকলেও বন্ধুত্বের অটুট যোগাযোগ এখনও বিদ্যমান।
ছোটবেলার সেই মধুময় সম্পর্ক এখনো আমাদের কাছে টানে। সুদীর্ঘ ৩২ বছর আগে আমরা ১৯৯১ সালে তেরখাদা নামক পল্লীকে বিদায় জানাই।
পুরাতন বন্দর থেকে নতুন বন্দর খুলনায় চলে আসি। বেড়ে উঠি এই খুলনার জন কোলাহলে।
কিন্তু ফেলে আসা অসংখ্য বন্ধু, অসংখ্য স্মৃতিঘেরা এই পল্লীকে আজো আমরা ভুলতে পারিনি। অসংখ্য মানুষের ভীড়ে তেরখাদাবাসীও আমাদের ভুলতে পারেনি। সম্পর্কের গভীরতা,স্মৃতির মধুময়তা বিস্মৃতির অতলে আটকিয়ে রাখা যায় না,এখনও এই বন্ধুত্বের অকৃত্রিম সম্পর্ক অটুট আছে,এ সম্পর্ক থাকবে চিরকাল।
লেখক পরিচিতিঃ মুনীর চৌধুরী সোহেল, আহবায়ক, গণসংহতি আন্দোলন, খুলনা জেলা।