# আবুল কালাম আজাদ……………………………………………
কৃষিজমিতে পানি পানি দেয়া সেচযন্ত্র স্যালোমশিন বা কৃষিজমিতে অগভীর নলকূপের মালিকরা স্থানীয়ভাবে পানিদার বলে পরিচিত। রাজশাহীর অঞ্চলের জেলাগুলো, বিশেষকরে বরেন্দ্রাঞ্চল গুলোতে লাখ লাখ কৃষকদের বহুদিন ধরে জীবন নিয়ন্ত্রণ করে আসছে । বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান সরেজমিনে ঘুরে জানসগেছে স্থানীয় কৃষকদের উপরে প্রভাবশালী পানিদারদের প্রবঞ্চনার নানা দিক।
গত বছর জীবনের এক কঠিন সিন্ধান্তের মুখোমুখি হতে হয় রাজশাহীর গোদাগাড়ী কৃষক দুই আদিবাসীকে। পাম্প অপারেটর ধান ক্ষেতে সেচ দিতে অস্বিকৃতী জানালে ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাজশাহীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার নিমঘুতু গ্রামের দু’জন আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক আত্মহত্যা করেন।
স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা টিউবওয়েল স্থাপনের অনুমতি পেতে সক্ষম হওয়ায় তারা সেচের পানির ব্যবস্থাপনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এরা দুই আদিবাসী কৃষকের মৃত্যু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এটি বাংলাদেশের একটি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। অথচ তারা সেটিকে ধামাচাপা দিতে গুজব ছড়ায় যে ওই দুই কৃষক অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মারা যায়।
“আত্মহত্যা করার আগে, দুই সাঁওতাল তাদের মাকে বলেছিল যে আগামী মাসে তাদের অনাহারে থাকতে হবে কারণ অপারেটর ধান ক্ষেতে সেচ দেয়ার অনুরোধে রাজী হয়নি। এরপর নিরুপায় হয়ে তারা ধান ক্ষেতে প্রয়োগ করার জন্য কেনা কীটনাশক পান করে মারা যায়,”
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কৃষক কালু শেখ, একদিকে তার নিউমোনিয়া আর পেটের পীড়ায় আক্রান্ত, অন্যদিকে স্ত্রী দীর্ঘদিন থেকে মরনব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত। নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যয়, আর অন্য দিকে নিজের ধানক্ষেতে সেচ দেয়ার জন্য পানির ব্যবস্থা করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকৎসার অভাবে চোখের সামনে যন্ত্রনায় স্ত্রীর মৃত্যু, অন্যদিকে সেচের অভাবে তার একমাত্র কৃষি জমিতে ধানগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল। কী করবেন কালু শেখ?
ঘোর বর্ষায় জমিতে পানির ব্যবস্থা করা, নাকি ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীর চিকিৎসা! স্ত্রীর চিকিৎসায় দরকার ৪০,০০০ টাকা অথচ হাতে আছে মাত্র ৪,০০০ টাকা।
অবশেষে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্ত্রীর চিকিৎসার চিন্তা বাদ দিয়ে সেচ পাম্পের মালিককে তুলে দেন হাতের জমানো টাকাগুলো। এই অগভীর নলকূপের মালিক চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বরেন্দ্রভূমি রাধানগর গ্রামের কৃষকদের জমিতে সেচের পানি সরবরাহ করে থাকেন।
তিনি এই অঞ্চলের সেচ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলেন। গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের এই অংশে তাপমাত্রা বেড়েছে, হ্রাস পেয়েছে বৃষ্টিপাত। যার ফলে সামনে যে কোনো সময় দেখা দিতে পারে খরা। আর সম্ভবত এটি জলবায়ু পরিবর্তনেরই একটি প্রভাব।
কালুশেখবলেন, “এ মুহুর্তে সেচের ব্যবস্থা না করলে হয়ত আমার জমিতে এ বছর আর ধান হবে না। আমি আমার মোটরওয়ালার [অগভীর পাম্প বা টিউবওয়েলের মালিক] কাছে গিয়েছিলাম এবং পানির জন্য বলতে গেলে একপ্রকার ভিক্ষা চেয়েছিলাম। হাতে টাকা না থাকায় পাম্পের মালিককে জমির ফসল কাটার পরে সেচের পানির মূল্য পরিশোধ করার প্রস্তাব দেন। সেসময় তার স্ত্রীও অসুস্থ্য ছিল, তার চিকিৎসায় অর্থের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু স্থানীয় সেই পাম্পের মালিক বলেন, “আগাম টাকা না দিলে জমিতে কোনো সেচ দেয়া হবে না।”
সেচের পানি বিক্রি বন্ধ করলে আমরা ধান চাষ করতে পারব না, ফলে আমাদের থাকতে হবে অনাহারে।
নিরুপায় হয়ে আমি তাকে সেচের পুরো টাকাটাই দেই। কারন তখন টাকা না দিলে হয়ত সামনের দিনগুলোতে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে। “আমার স্ত্রীর চিকিৎসা না হয় কিছুদিন বিলম্ব হতে পারে, তবে সেচের পানি নিয়ে বিলম্ব করা যাবেনা।”
“আমার আশেপাশের কৃষকদের প্রত্যেক মৌসুমে পানির জন্য তাদের কাছেই যেতে হয়। তিনি যদি পানি বিক্রি বন্ধ করে দেন, আমরা হয়ত আর ধান চাষ করতে পারব না। আর তার ফলে আমাদের সবাইকে নিয়ে অনাহারে থাকতে হবে,।”
কৃষক আক্তার বলেন, জুলাই মাসে, এই সব পাম্প থেকে পানির মূল্য ছিল বিঘা (০.১৩ হেক্টর) প্রতি ঘণ্টায় ১৮০ টাকা । কিন্তু তাপপ্রবাহের সময় এটি বেড়ে গিয়ে মূল্য দাঁড়ায় ৫০০ টাকা।
“২০২২ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে কালুশেখের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নিজের বাড়িতে অসুস্থ্য স্ত্রীর বুকে সরিষার তেল মালিশ করছিলেন কালুশেখ, যাতে যন্ত্রনা কিছুটা লাঘব হয়। স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “আগামী সপ্তাহে ধানক্ষেতে আরও সেচের প্রয়োজন হবে। আমি চিন্তায় আছি কিভাবে সেই টাকা জোগাড় করব।”
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সেচ সংকটের সম্মুখীন ১৬টি খরা-প্রবণ কিন্তু উর্বর জেলার লক্ষাধিক কৃষকদের একজন হলেন কালুশেখ। এই জেলাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বরেন্দ্র অঞ্চলটি।
সেচের সমস্যা মূলত শুরু হয় ১৯৭০ এর দশকে, যখন গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ভারত অপসারণ করতে শুরু করে। এর সাথে যুক্ত হয় খরা যার প্রভাবে এই অঞ্চলের নদী, পুকুর এবং অন্যান্য জলাভূমিতে পানির প্রাপ্যতা কমতে শুরু করে। এই পরিস্থিতি শুরু হলে বাংলাদেশ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে মোটর চালিত সেচ ব্যবস্থা চালু করে। আর এরই মধ্য দিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে উদ্ভব হয় নতুন একধরনের ধনীক শ্রেণী যারা যাদেরকে মোটরওয়ালা (পাম্পের মালিক) বা পানিওয়ালা (পানির মালিক) হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠে। এই শ্রেণীর লোকেরা অগভীর টিউবওয়েল (এসটিডব্লিউ) স্থাপন করে ভূগর্ভস্থ পানি পাম্প করে কৃষি জমিতে সেচের ব্যবস্থা চালু করে।r.
সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট তদারকি না থাকায়, এই ‘নব্য পানিদার’ বা পাম্প মালিকরা দরিদ্র কৃষকদের কাছ থেকে সেচের পানির জন্য চড়া মূল্য নিয়ে থাকে। সরকারের তালিকাভুক্ত মোটর অপারেটররা এসব বেসরকারী পাম্পের মালিকদের সাথে মিল রেখে একটি অন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে, যা চাহিদার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।
বাংলাদেশের একজন সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যিনি এখন জাতীয় সংসদের উপনেতা। গতবছর নভেম্বরে তিনি বলেন যে তিনি ২০১৪ সালে বিষয়টি নিয়ে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। সেসময় তিনি বলেন, নতুন এই ‘পানি ব্যবসায়ীরা’ (বা পানি প্রভুরা) ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের জমিদারদের প্রতিস্থাপন করেছে। তিনি বলেন, “ভূমি মালিকরা বছরে একবার প্রান্তিক কৃষকদের শোষণ করত। কিন্তু এই পানি ব্যবসায়ীরা সারা বছরই দরিদ্র কৃষকদের শোষণ করে থাকেন।কীভাবে কাজ করে বাংলাদেশের সেচ ব্যবস্থা?
বেসরকারী সেচ ব্যবস্থা পরিচালনাকারীদের দৌরাত্ম্যে অসহায় দরিদ্র কৃষক
রবি পাল* (২৫)। সে একজন দরিদ্র হিন্দু কৃষক। নওগাঁ জেলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খরা-প্রবণ অঞ্চল মহদেবপুর উপজেলার একটি গ্রামে তিনি বসবাস করেন। নিম্ন গোত্রের হিন্দু সম্প্রদায়ের এই কৃষক তার নিপীড়িতৃ হওয়ার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, স্থানীয় অগভীর পাম্পের মালিক তার জমির ফসল একেবারেই বিনষ্ট করে দিয়েছে।
রবি পালের মোট আবাদী জমির ১৯ কাঠা (হেক্টরের এক দশমাংশ) কিছুটা উঁচু জমিতে যেখানে তিনি ধানের চাষ করেন। এছাড়া ও তার আরো ১৭ কাঠা জমি রয়েছে যেটি কিছুটা নিচু জমি। তিনি তার আবাদী জমি দেখিয়ে বলেন যে তার নিচু জমিটি সারা বছরই পানির নিচে থাকে ।
তিনি আরো বলেন, “আমি পানিওয়ালাকে (পাম্প মালিক) বলেছিলাম যে আমার নিচু জমির জন্য সেচের কোনো দরকার নেই। তাই আমি তার কাছ থেকে পানি কিনতে চাইনি। কিন্তু পানিওয়ালার একটাই শর্ত – নিচু জমির জন্য পানি না কিনলে, তারা আমাকে উঁচু জমির জন্য পানি দেবে না।
রবি পাল বলেন, “তারা নিচু ধানক্ষেতে এত পানি দেয় যে তার সেই জমির ফলন ৫০ শতাংশ কমে যায়। “আমি সাধারণত এই ১৭ কাঠা জমিতে ২০ মণ [প্রায় ৭৫০ কিলোগ্রাম] ধান পেতাম। কিন্তু এবার তা নেমে এসেছে মাত্র ১০ মনের মধ্যে (৩৭০ কিলোগ্রাম)।
নওগাঁর মহদেবপুরের এক কৃষক তার ধান ক্ষেতে কাজ করছেন। তিনি বলেন, সেচের জন্য তিনি সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় পানি ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল।
রবিপাল,কালুশেখের মতই আবিদ হাসনাইন* (৫৫)। সেচের পানি নিয়ে তার অভিজ্ঞতা একই।
কৃষক আবিদ বলেন, “আপনি যদি উঁচু জমির ধানক্ষেতের জন্য পানি চান তাহলে তারা আপনাকে নিচু জমির জন্যও পানি কিনতে বাধ্য করবে।
আবিদ হাসনাইন বলেন, “একজন মোটরওয়ালা যদি রেট (মূল্য) বাড়ায়, অন্যরা সাথে সাথে সেই রেট নির্ধারণ করে দেয়।” হাসনাইন বলেন, পানির মালিকদের সাথে তার বেশ কয়েকবার ঝগড়া হয়েছে। গ্রামের কৃষকরা জানান, মোটর মালিক হিন্দু-মুসলিম যেই হোক না কেন দাম নিয়ন্ত্রণে তারা ঐক্যবদ্ধ। একজন কৃষক হিন্দু, মুসলিম, প্রান্তিক বা আদিবাসী, যেই হােক না কেন, তাদের অতিরিক্ত মূল্য প্রদান করতেই হয়।
একই এলাকার অনিল পাল (রবির সাথে অবশ্য তার কোন সম্পর্ক নেই), কৃষকদের অসহায়ত্বের কথাই তুলে ধরেন।তারা তাদের ইচ্ছামতো সেচের পানির মূল্য নির্ধারন করে। আর আমরা যেন তাদের হাতের খেলার পুতুল ।
মকবুল মন্ডল, নওগাঁ জেলার একজন প্রান্তিক কৃষক“এই বর্ষায় বৃষ্টি নেই। পানি স্বল্পতার কারণে আমরা এ মৌসুমে চাষ করতে পারছি না। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা মোটরওয়ালাদের হাতে বন্দী। “আমাদের মোট কৃষি ব্যয়ের অন্তত ২০ শতাংশই চলে যায় পানির মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে,। মোটরওয়ালারা অগ্রিম অর্থ প্রদানের জন্য চাপ দেয়। “কিন্তু অনেক অসচ্ছল কৃষক অগ্রিম অর্থ প্রদান করতে অক্ষম। তারা কি করবেন?
রাজশাহীর তানোরের প্রান্তিক কৃষক আমজাদ বলেন, ক্ষমতার সবটুকুই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) অপারেটর আর নলকূপ মালিকদের কাছে কুক্ষিগত।“তারা তাদের ইচ্ছামতো সেচের মূল্য নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে আমরা কেবল বন্দী, অসহায়,” তিনি বলেন। “আমরা যদি অগ্রিম টাকা না দিই, ধান পাকার সময়ে তারা সেচ দেয়া বন্ধ করে দেবে। অনেক ক্ষেত্রে, কৃষকরা তাদের গবাদি পশু বিক্রি করে এই অর্থ পরিশোধ করে।”
সবারই যেন পাম্প মালিক হওয়ার তাড়া অগভীর নলকূপে বিনিয়োগ অত্যন্ত লাভজনক। এই ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা জানান যে এই ধরনের একটি মেশিনের মূ্ল্য ৫০০,০০০ টাকা । সরকার এসব অগভীল নলকূপ মালিকদের কাছে ভর্তুকি হারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।
অনিল পাল এবং হাসনাইন যে গ্রামে বাস করেন সেখানে এই ধরনের একটি নলকূপ মালিকের জন্য কাজ করেন এমন একজন বলেন, একটি অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ১০০ বিঘা (১৪ হেক্টর) জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব। তিনি বলেন, বর্ষাকালে কৃষকদের বিঘা প্রতি ১৫০০ টাকা দিতে হয়, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এটি বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার টাকায়।
“আমরা একতরফাভাবে হার নির্ধারণ করিনি। আমরা অন্য সব মালিকদের সাথে পরামর্শ করে নির্ধারিত হার অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করেছি, ” তিনি বলেন। এর সঙ্গে যুক্ত করে তিনি বলেন, “আমাদের ব্যবসা বেশ ভালোই হয়”।
ওই এজেন্ট বলেন, এই স্কীমের মধ্যে থাকা কৃষকদের আসলে আর কোনো বিকল্প নেই। মানুষ সেচের পানির জন্য বলতে গেলে একপ্রকার ভিক্ষাই করে থাকে।” আমাদের বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় আর মেশিনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এছাড়া আমাদের কোনো খরচ নেই কারণ পানি তো আসে মাটির নিচ থেকে।
বগুড়া জেলার একটি অগভীর টিউবওয়েলের মালিক তার পাম্প হাউসের সামনে। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই ধরনের পাম্প স্থাপনের জন্য রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। কারন এটি খুবই লাভজনক। যারা পারমিট পান তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন যদিও স্থানীয় কৃষক, কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই শিল্পের সাথে মূলত যুক্ত থাকেন অপেক্ষাকৃত অর্থ ও ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিবর্গ।
নওগাঁর মহদেবপুর উপজেলার বিএমডিসির সহকারী প্রকৌশলী সেলিম রেজা বলেন, সরকার ২০১৯ সালের মে মাসে একটি পদ্ধতি চালু করে। এই পদ্ধতি অনুসারে প্রতি সেকেন্ডে ০.৫ ঘনফুট ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি অগভীর নলকুপের মধ্যে কমপক্ষে ২৫০ মিটার দুরত্ব থাকতে হবে। অপরদিকে ২ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি গভীর নলকূপের মধ্য কমপক্ষে ৫০০ মিটার ব্যবধান থাকতে হবে।“কিন্তু এটি খুব কম ক্ষেত্রেই বজায় রাখা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা প্রতিবছর নতুন নতুন অগভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য কমপক্ষে ৫০টি আবদেন পেয়ে থাকি।
“মহাদেবপুরে, অগভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমোদন আর কোনো সুযোগ নেই। এখানে যদিও সম্পৃংক্ত হবার সুযোগ থাকলেও বার বার দেখা যাচ্ছে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই অনুমোদন পেয়ে যাচ্ছে,” সেলিম রেজা বলেন। তিনি বিএমডিএ কর্মকর্তা হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে স্থানীয় সেচ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করেন।
“সম্প্রতি আমরা একটি তদন্তে দেখেছি যে যে নয়জন ব্যক্তি সরকারী নিয়ম লঙ্ঘন করে স্বল্প ব্যবধানের মধ্যে কয়েকটি নলকূপ স্থাপন করেছে। আমরা শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব,” তিনি বলেন।
অগভীর নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অনিয়ম হয়েছে বলে স্বিকার করেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ।
এবছর ১৯ জানুয়ারি তিনি বলেন, “স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান হলেন উপজেলা সেচ কমিটির প্রধান যিনি অগভীর নলকূপ স্থাপনের আবেদন অনুমোদন করে। অপরদিকে বিএমডিএ কর্মকর্তা হলেন সেচ কমিটির সদস্য সচিব। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে আমরা সব সময় আইন প্রয়োগ করতে পারি না। তারা চাপ দিলে আমরা অনেক সময়ই অনুমোদন দিতে বাধ্য হই।”
এছাড়া কমিটি দ্বারা পরিচালিত পদ্ধিতেও রয়েছে সমস্যা শুধুমাত্র যে ব্যক্তিগতভাবে পরিচালিত অগভীর টিউবওয়েল পদ্ধিতিতে সমস্যা রয়েছে তা নয়। বিএমডিএ দ্বারা স্থাপিত গভীর টিউবওয়েল আবাসিক কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়, যারা পাম্প চালানোর জন্য একজন সুপারভাইজার নিয়োগ করে।
অপারেটররা তাদের জমিতে সেচ দেয়ার জন্য অগভীর নলকূপ মালিকদের সমান পরিমাণে কৃষকদের কাছ থেকে পানির মূল্য নেয়, আর কৃষকরা এই সব সম্পদের মালিকদের কাছে অনেকটা করুণার পাত্র হিসেবে থাকে। এসব ক্ষেত্রে প্রান্তিক গোষ্ঠী এবং আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি শোষণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
পাম্প অপারেটর ধান ক্ষেতে সেচ দিতে অস্বিকৃতী জানালে ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাজশাহীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার নিমঘুতু গ্রামের দু’জন আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক আত্মহত্যা করেন।
রাজশাহীর সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা ২০২২ সালের জুন এবং আগস্টে বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা টিউবওয়েল স্থাপনের অনুমতি পেতে সক্ষম হওয়ায় তারা সেচের পানির ব্যবস্থাপনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এরা দুই আদিবাসী কৃষকের মৃত্যু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এটি বাংলাদেশের একটি স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। অথচ তারা সেটিকে ধামাচাপা দিতে গুজব ছড়ায় যে ওই দুই কৃষক অতিরিক্ত মদ্যপানের কারনে মারা যায়।
“আত্মহত্যা করার আগে, দুই সাঁওতাল তাদের মাকে বলেছিল যে আগামী মাসে তাদের অনাহারে থাকতে হবে কারণ অপারেটর ধান ক্ষেতে সেচ দেয়ার অনুরোধে রাজী হয়নি। এরপর নিরুপায় হয়ে তারা ধান ক্ষেতে প্রয়োগ করার জন্য কেনা কীটনাশক পান করে মারা যায়।
ফজলে হোসেন বাদশা বলেন। “আমি হস্তক্ষেপ না করলে পুলিশ তদন্ত করত না,” তিনি বলেন। একজন অপারেটর এই মুহুর্তে কারাগারে আছে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে।
নওগাঁ জেলার একটি গ্রামের কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন যে বিএমডিএ পরিচালিত গভীর টিউবওয়েলের স্থানীয় অপারেটররা ২০২২ সালের বর্ষা মৌসুমে সেচের জন্য পানির দাম বাড়িয়েছিল।আমরা পাম্পের মালিক এবং অপারেটরদের নাচের পুতুল।
আব্দুল রশিদ, নওগাঁ জেলার একজন প্রান্তিক কৃষক“প্রধানকুন্ডি গ্রামের প্রান্তিক কৃষক করিমুল ইসলাম বলেন, “আগে আমরা প্রতি বিঘা ১৫০০ টাকা দরে পানি পেতাম। কিন্তু চলতি মৌসুমে তারা নতুন নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। এখন প্রতি ঘণ্টায় পানি কিনতে হচ্ছে। ঘন্টা প্রতি ৩০০ টাকা হারে চার্জ নেয়অ হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, “যদি আমরা এক ঘণ্টার চুক্তিতে সম্মত হই, তাহলে আমাদের ১০ বার সেচের জন্য ৩,০০০ টাকা [প্রতি বিঘা] খরচ হবে।
“আমরা আসলে পাম্পের মালিক আর অপারেটরদের হাতের পুতুল। যখন পাম্প মালিকরা চার্জ বাড়ায়, গভীর নলকূপের অপারেটররাও তাই করে। যদি তারা পানি দেয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে চাষীদের অন্য কিছু করার থাকেনা,” তিনি বলেন।
“বরেন্দ্র (বিএমডিএ) কিছু সৌরবিদ্যুৎ পাম্পও পরিচালনা করে, কিন্তু তারাও একই পরিমাণে চার্জ করে। এটা সত্যিই হতাশাজনক,” বলেন রশিদ।
ভূগর্ভস্থ পানি নেমে যাওয়া এবং শোষিত কৃষকদের নিয়ে রাজনৈতিক উদ্বেগ
উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশের বর্তমান সেচ ব্যবস্থার আরেকটি ক্ষতিকর দিক হচ্ছে দিন দিন ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া। গবেষণায় যদিও ১৯৮০’র দশক থেকে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে বলে দেখা যায় তবে পানির স্তর বর্ষা মৌসুমে প্রতি বছর ১.৩৭ ফুট এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বছর ০.৭২ ফুট পর্যন্ত হ্রাস পাচ্ছে।
রাজশাহীর সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন ,“আমি কয়েকবার সংসদে বলেছি যে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বেসরকারি পাম্প অপারেটররা বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে পুরো উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। এটা টেকসই নয়। প্রতি বছর আমরা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের বিশাল পতন দেখতে পাই।” তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধে সরকারের হস্তক্ষেপ করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান ব্যবস্থার সাথে দুটি বড় সমস্যা রয়েছে – ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপকভাবে নিচে নেমে যাওয়া এবং কৃষকদের জন্য নির্ধারিত বিদ্যুত ভর্তুকিতে মূলত পানি ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া লাভ।
সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, “আমাদের কৃষক এবং পুরো কৃষি ব্যবস্থাই পানি ব্যবসায়ীদের হাতে বন্দী হয়ে আছে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য পাম্প মেশিন স্থাপনের অনুমতি পাওয়ার জন্য তারা সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষও প্রদান করে।”
“আমাদের অনেক নদী আছে।” আমাদের অবশ্যই টেকসই কৃষির জন্য ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের উপায় খুঁজে বের করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক রশিদ বলেন, “আপনাদের ভাবতে হবে যে আমরা রাতারাতি সেচের জন্য ভূ-পৃষ্ঠের উপরের পানিতে যেতে পারব না। এটা পরিবর্তন প্রয়োজন, এনিয়ে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সেচের সিংহভাগই বলতে গেলে ভূপৃষ্ঠের পানি থেকেই পাওয়া যাবে।#