আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল আজ এ আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। একইসঙ্গে জনাকীর্ণ ট্রাইব্যুনালে আজ শুনানিতে আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেয়া হয়।
জুলাই-আগস্ট গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারাগার থেকে আজ কড়া নিরাপত্তায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী আনিসুল হক, ফারুক খান, ড. দীপু মনি, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, তৌফিক-ই-ইলাহী, শাজাহান খান, কামাল আহমেদ মজুমদার, গোলাম দস্তগীর গাজী, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। আজ সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ ১৪ জনকে হাজিরে গত ২৭ অক্টোবর আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক অন্য মামলায় রিমান্ডে থাকায় আজ তাকে হাজির করা সম্ভব হয়নি। তাদের সকলকে ট্রাইব্যুনালে আনা অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং পরবর্তী ধার্য তারিখে আসামিদের ট্রাইব্যুনাল হাজিরের আদেশ দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই-আগস্ট গনহত্যার সুপিরিয়র রেস্পন্সিবিলিটি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারের উপযোগী তদন্ত রিপোর্ট দাখিলে আমরা দুই মাসের সময় চেয়েছিলাম। ট্রাইব্যুনাল এক মাসের সময় দিয়েছেন৷ আমরা আশা করছি শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ট্রাইবুনাল শেখ হাসিনার গ্রেফতার প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে গিয়ে তিনি ভারতে রয়েছেন। আমরা তাকে গ্রেফতারে ইন্টারপোলকে নোটিশ করেছি। ভারতের সাথে বন্দী বিনিময় চুক্তি রয়েছে সরকারের। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়ার কথা আমরা জেনেছি।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আজকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথমবারের মতো বিগত সরকারের মন্ত্রী উপদেষ্টাসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৩ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তিনি বলেন, আজকের দিনটা বাংলাদেশের আগামী দিনে যারা ফ্যাসিষ্ট, স্বৈরাচারী হবেন তাদের জন্য একটা শিক্ষার দিন। ক্ষমতার দম্ভে দেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করে, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েও ক্ষমতায় থাকা যায় না, এসব কার্যক্রমের জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয় আজকের দিন সে শিক্ষা নেয়ার দিন।
তাজুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ সাল থেকে কিভাবে একটা রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে তার পটভূমি আজ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছি। একটি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ, পারিবারিকীকরণের মাধ্যমে নিপীড়ক সংস্থায় কিভাবে পরিণত করা হয়েছিল আজ তা তুলে ধরেছি।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস, মতিঝিল শাপলা চত্বরে সাধারণ মানুষকে হত্যা করার মাধ্যমে প্রতিবাদী জনতাকে স্তব্ধ করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা অন্যায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করা হয়েছে। একের পর এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি ও তার পরিবারকে ক্ষমতা রাখার উদ্দেশ্যে এসব অপরাধের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ছাত্র সমাজ ও জনগণের যৌক্তিক দাবী অনুধাবন না করে উল্টো তাদের নির্মূলে রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয় ক্যাডারদেরকে সর্বাত্মকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
রাজাকার ট্যাগ দিয়ে বারবার জাতিকে বিভক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হয়েছে। মেধাবীদের বৈষম্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন নির্মূলের লক্ষ্যে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা, ২৫ হাজার মানুষকে আহতসহ পুরো দেশজুড়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তিনি বলেন, নিপীড়নের মাত্রা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে লাশ দাফন, চিকিৎসায় বাধা দেয়া হয়েছে। লাশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মৃত্যু সনদ এবং লাশ দাফনে পারিবারিকভাবে সুযোগও দেয়া হয়নি। কতটা নির্মম ছিল এসব গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তা বর্ণনাতীত। এইসব অপরাধ হিটলারের নাৎসিবাহিনীর অপরাধের চেয়েও ভয়ংকর বলে বলে মনে করেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, এ গণহত্যায় শতাধিক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দমনে এলোপাতাড়ি গুলিতে বাসা বাড়িতে থাকা লোকজনও মৃত্যুবরণ করেছেন। সকল নিষ্ঠুরতম নিপীড়ন, গুম, খুন, আয়না ঘরে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতনের বিষয়ে দেশি বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, আজ যে ১৩ জনকে হাজির করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি ছাড়াও আলাদা আলাদা অভিযোগ রয়েছে।
আজ ট্রাইব্যুনালে ২ জন আসামির পক্ষে আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু শুনানিতে দাঁড়ান। শুনানির সার্বিক প্রস্তুতি অসম্পন্ন থাকায় তাকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্নে বলা হয়। অন্য আসামিদের পক্ষে ওকালতনামা দাখিলে আবদেন করলে তা মঞ্জুর করা হয়।
এর আগে গত ২৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই-আগস্ট গণহত্যার মামলায় কারাবন্দি সাবেক দুই উপদেষ্টা, সাবেক ১০ মন্ত্রী, এক সেনা কর্মকর্তা ও সাবেক এক সচিব, এক বিচারপতিসহ ২০ জনকে হাজির করতে নির্দেশ দেন। এর মধ্যে ১৪ জনকে আজ ১৮ নভেম্বর হাজির করতে বলা হয়েছিল। ড.আবদুর রাজ্জাক ছাড়া ১৩ জনকে আজ হাজির করা হয়।
এছাড়া পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্তকৃত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, আব্দুল্লাহ আল কাফি, আরাফাত হোসেন, আবুল হাসান ও মাজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার দেখিয়ে আগামী ২০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে গত জুলাই ও আগস্টে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়। এসব অভিযোগের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরই অংশ হিসেবে নতুন প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থা গঠিত হয়েছে। বিচারের জন্য আইন সংশোধন ও ট্রাইব্যুনাল ভবন মেরামতের কাজও চলমান। গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ, ১৪ দলের নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত গুম, হত্যা, গণহত্যাসহ একশত ২৫ টির বেশি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে জমা পড়েছে।
গত ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার। আর ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্টের বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এর আগে চিফ প্রসিকিউটরসহ প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা নিয়োগ দেয়া হয়।
গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের পতন হয়।
গত জুলাই-আগস্টে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে। জাজ্বল্যমান এ অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে।#বাসস