বিশেষ প্রতিনিধি: আমের মৌসুম ঘিরে পাল্টে যায় আমের ভান্ডার হিসেবে খ্যাত রাজশাহীর বাঘা-চারঘাটের চিত্র। গাছের পরিচর্চা থেকে শুরু করে, গাছ থেকে আম নামিয়ে বিক্রি করা পর্যন্ত বাগান মালিক, ব্যবসায়ী, কুলি শ্রমিক,পরিবহন, ঝুড়ি,কাগজ বিক্রেতাসহ নানান পেশাজীবি লোকজন ব্যস্ত হয়ে উঠেন । এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শুধু নাজেহালে পড়েছেন আম বাগান মালিক-ব্যবসায়ীরা।
এ বছর আমের দরপতনে খরচ উঠাই মুস্কিল হয়ে পড়েছে। গত বছর আম রপ্তানি হলেও এবার কোন আম রপ্তানি করা যায়নি। আম চাষিরা বলেছেন, কুটির শিল্পের মাধ্যমে আম পসেসিং সেন্টার গড়ে তুলতে পারলে আমকে টিকে রাখা সম্ভব হবে। যা পর্যায়ক্রমে বিক্রি করা যাবে।
নিজের জমিসহ লিজ নিয়ে দেড়শ’ বিঘা জমিতে আম চাষ করেছেন, বাঘা উপজেলার সাদি এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারি শফিকুল ইসলাম (ছানা)। গত বছর ২২ মেঃ টন আম রপ্তানি করেছিলেন। এবছর কোন আমই রপ্তানি করতে পারেননি। তিনি বলেন, এবার সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে। আমের ফলন ভালো হলেও ক্রেতা অভাবে আম বিক্রি করতে পারছেননা। গাছেই আম পেঁকে ঝরে পড়ছে।
এখন লখনা আম বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা মণ। সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৬০০শ’ টাকা মণ। হিমসাগর (ক্ষিরশাপাত) ১৪০০-১৬০০শ’ টাকা ,ন্যাংড়া ১৩০০-১৪০০শ’ টাকা,আম্রপালি ১৪০০-১৮০০শ’ টাকা,ফজলি ৬০০-৭০০শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
শফিকুল ইসলাম জানান, গত বছর লখনা আম ৯০০শ টাকার নীচে নামেনি। হিমসাগর বিক্রি করেছেন- ৩৮০০শ’ থেকে ৪০০০ হাজার টাকা, আম্রপালি- ৩৮০০-৪২০০শ’ টাকা আর ন্যাংড়া ৩০০০ হাজার থেকে ৩৫০০শ’ টাকা মণ। এবার নিচ্ছে ৪৮ কেজিতে মণ। গত বছর ছিল ৪৫ কেজিতে মণ।
বাগান মালিকরা জানান,১বিঘা জমিতে গড়ে ৫০মণ আম উৎপাদন হয়। বিঘা প্রতি খরচ হয় ৫০ হাজার টাকা। আম নামানোর আগে অন্তত তিনবার পরিচর্চা খরচ হয়। বাগান মালিক-ব্যবসায়ীরা জানান,একজন শ্রমিক ছোট-বড় গাছ মিলে ৫ থেকে ৮মন আম নামাতে পারে। সকালে-বিকেলে খাবারসহ একজন শ্রমিকের খরচ লাগে ৫০০ টাকা। ২৫ কেজি ওজনের একটি ঝুড়ি ট্রাকে তুলে দেওয়া পর্যন্ত লাগে ১৫ টাকা,দড়ি-কাগজ লাগে ৬ টাকা,কুরিয়ারে দিলে কেজি প্রতি লাগে ১৩ থেকে ১৬ টাকা, দুরত্ব বুঝে ভ্যান ভাড়া মণ প্রতি ১০-২০টাকা,প্লাস্টিকের ক্যারেট লাগে ২২৫ টাকা,কার্টুনে লাগে ৭০ থেকে ৮০ টাকা । এর সাথে আছে পরিচর্যা খরচ।
উপজেলার আড়াপাড়া এলাকায় ৭০ বিঘা বাগানে এবার আম চাষ করেছেন আনোয়ার হোসেন পলাশ। তিনি বলেন,এবার অবস্থা যা হয়েছে, উৎপাদনের খরচ উঠবে না কারও। এভাবে চললে আমচাষিরা ভবিষ্যতে আম উৎপাদন করতে কয়েকবার চিন্তা করবে। এবার মৌসুমের শুরুতে আমের দাম ভালো থাকলেও পরে দাম কমে এসেছে। শুধু বাঘাতেই নয়, একই অবস্থা রাজশাহীর চারঘাটেও। চারঘাটের ডাকরা কাজল মোড়ের বাগান মালিক খায়রুল ইসলাম বলেন, ক্ষিরশাপাত, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলি,লখনা একই সঙ্গে পেঁকে গেছে। একসঙ্গে এত আম পেকে যাওয়ার কারণে দাম অনেকটা কমে এসেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে আম ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এর পরেও ক্রেতার দেখা মিলছে কম।
চকছাতারি গ্রামের আম ব্যবসায়ী মুক্তার আলী জানান, এবার আমের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তার ২৮ লাখ টাকার আম বাগান কেনা ছিল। এখন পর্যন্ত আম বিক্রি করেছেন ১২ লাখ টাকা। বাগানে যে আম আছে, তা ৮লাখ টাকা বিক্রি হতে পারে। সে হিসেবে তার ৮লাখ টাকা মতো লোকসান হবে। তিনি জানান,বিগত বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাকে আম নিয়ে বিক্রি করলেও এবার চাহিদা না থাকায় সেভাবে বিক্রি করতে পারছেন না।
বলিহার গ্রামের সৌমেন মন্ডল জানান,এলাকায় লখনা আম ১৫ টাকা কেজি কিনে সিলেটে বিক্রি করেছেন ৩৫ টাকা। খরচ বাদে কেজিতে টিকেছে ৭ টাকা। আমের দরপতনের বিষয়ে- কৃষিবিদ, উদ্যোক্তা ও আম চাষিদের সঙ্গে কথা বলে যে কারণের কথা জানা গেল। সেগুলো হলো—বৈরী আবহাওয়া, নিয়ন্ত্রণহীন কীটনাশক ও বৃদ্ধিকারকের ব্যবহার এবং ঈদ উপলক্ষে দীর্ঘ ছুটি ও অনলাইনে বিক্রি কম। তবে নির্ধারিত আয় কমেনি, আম নামানো থেকে শুরু করে,প্যাকিং ও পরিবহন সেক্টরে যারা যুক্ত আছেন।
কুলি শ্রমিক সংগঠনের নেতা আমিরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন একেকজনের আয় হয় ১০০০ টাকা। তাদের মতো মৌসুমের ৪মাস আয় করেন আমের সঙ্গে যুক্ত নানান পেশার লোকজন। ‘ফুটস এ্যাডড্রেস’ পেজ খুলে অনলাইনে আম ব্যবসা শুরু করছেন, নিশ্চিন্তপুর গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা কলেজ ছাত্র সোহানুর রহমান (শাওন)। তিনি জানান, গুণগত মান দেখে এলাকার বাগান মালিকদের কাছ থেকে আম কিনে প্যাকিং করেন। সেই আম কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
সোহানুর রহমান (শাওন) জানান,এখন চাহিদা কমে এসেছে। ৪/৫দিন আগে হিমসাগর ১০ মণ করে আম দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়েছেন। চাহিদা বেশি ছিল হিমসাগর আমের।
বাঘা শাখার সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থাপক জহুরুল ইসলাম ও এজেআর কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থাপক আশরাফ আলী বলেন, ‘আমের মৌসুমে ব্যবসাটা অনেক ভালো চলে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে অনলাইনে বেচাকেনা বেশি হলে ব্যবসা আরও জমে উঠে। #