মোঃ মমিনুল ইসলাম মুন, বিশেষ প্রতিনিধি :
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে বাল্যবিবাহ যেন এক নীরব দুর্যোগের নাম। আইনে বাল্যবিবাহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও বাস্তবতার নিরিখে এটি হয়ে উঠেছে নিত্যনৈমিত্তিক সামাজিক চর্চা। প্রশাসনের নীরবতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জন্মনিবন্ধন জালিয়াতি এবং কিছু মুনাফালোভী কাজীর অর্থলোভী ভূমিকা—সব মিলিয়ে কন্যাশিশুর ভবিষ্যৎ আজ ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে। বিশেষ করে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার নয়টি থানায় (পবা, মোহনপুর, চারঘাট, বাঘা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া,তানোর, গোদাগাড়ী ও বাগমারা) একাধিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে একই চিত্র।
বয়স বাড়িয়ে জন্মসনদ বানানো হচ্ছে, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের স্বাক্ষরে সেই সনদ বৈধতা পাচ্ছে, আর কিছু কাজী শুধুমাত্র টাকা পেলেই বিয়ে রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসন এসব বিষয়ে অবগত থাকলেও বহু ক্ষেত্রেই কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, অধিকাংশ বাল্যবিবাহই সংগঠিত হচ্ছে বয়স গোপন করে। মেয়েটির প্রকৃত বয়স ১৪–১৫ হলেও জন্মসনদে তা ১৮ বা তদূর্ধ্ব দেখানো হয়। এই কাজে একাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা ওয়ার্ড মেম্বারের সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুরোধে, আবার কোথাও রাজনৈতিক প্রভাবে এই বয়স বাড়ানো হচ্ছে নির্বিঘ্নে। এরপর এসে যোগ হয় কাজীদের ভূমিকা। বয়স যাচাই না করেই কিছু কাজী শুধু অর্থের বিনিময়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করছেন। তাদের কথায়“বয়স ঠিক আছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব চেয়ারম্যানের, আমি শুধু কাবিননামা লিখে দিচ্ছি।” এই দায় এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এটি একটি সামাজিক অপরাধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার শামিল।
এই চক্রের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে মেয়েটি নিজেই। তার হাতে থাকার কথা ছিল বই, থাকার কথা ছিল স্বপ্ন,কিন্তু বাস্তবতা তাকে ঠেলে দিচ্ছে সংসারের জাঁতাকলে। অনেকেই অপ্রাপ্ত বয়সে মাতৃত্বের ঝুঁকিতে পড়ে, আবার কেউ হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ১৫-১৬ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে বাল্যবিবাহের শিকার। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে জন্মসনদে বয়স বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, যেখানে জনপ্রতিনিধি ও কাজীর জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে প্রতিটি থানাতেই এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটছে বলে জানা গেছে।
আইন থাকা সত্ত্বেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে রাজশাহীর এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “বাল্যবিবাহ রোধে প্রশাসন নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। তবে অনেক সময় ভুয়া জন্মনিবন্ধন ও স্থানীয় সামাজিক চাপে সত্যিকারের বয়স যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবুও আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।”
রাজশাহীর জেলা প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা কাজীদের তালিকা পর্যবেক্ষণ করছি এবং বাল্যবিবাহে জড়িত থাকলে তাদের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ পাঠানো হয়। জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে স্থানীয় পর্যায়ে আরও সচেতনতা ছাড়া শুধু প্রশাসনিক তৎপরতায় দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন সম্ভব নয়।” এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি পদক্ষেপ হলো—প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, জন্মনিবন্ধন যাচাই বাধ্যতামূলক করা, কাজী ও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, এবং গ্রামীণ পর্যায়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা।
প্রতিটি স্কুল, মসজিদ, ইউনিয়ন অফিস—প্রতিটি জায়গায় সচেতনতামূলক প্রচার চালানো দরকার। আজ যাদের জীবন থেমে যাচ্ছে বাল্যবিবাহের পিঁড়িতে, কাল তারাই হতে পারত এই সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাতা। এই নিরব সহিংসতা থামাতে হলে এখনই সময় দাঁড়ানোর।#