1. admin@sobujnagar.com : admin :
  2. sobujnoger@gmail.com : Rokon :
বুধবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:৪০ অপরাহ্ন
সর্বশেষ:
বিএমডিএ চূড়ান্ত প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া ৪৮০ জন এসআই’র প্রশিক্ষন সমাপনীত রাজশাহীতে পুলিশের আইজির প্যারেড পরিদর্শন পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের রজতজয়ন্তী ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের উদ্ভোধন পলাশ উপজেলা প্রেসক্লাবের কম্বল পেলেন শীতার্তরা ঝালকাঠিতে বেসরকারি ঋনদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত খুলনায় নভোথিয়েটার প্রকল্প বাতিলের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি  রাজশাহী জেলা ছাত্রদল নেতার পিতা বাচ্চু সরকারের দাফন সম্পন্ন উপ-সম্পাদকীয়: আমার চোখে স্মরণীয় মাধ্যমিক শিক্ষকদের অবিস্মরণীয় ঘটনা বাংলাদেশের রাজধানী হলো ঢাকা, আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ডিসি সামাদ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ছাত্রদল নেতাকে কুপিয়ে জখম

উপ-সম্পাদকীয়: আমার চোখে স্মরণীয় মাধ্যমিক শিক্ষকদের অবিস্মরণীয় ঘটনা

  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ১২ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে

৥ মুনীর চৌধুরী সোহেল৥

প্রতিটি মানুষের বয়স বাড়লেও তার ছোটবেলার স্মৃতি ভুলে যায় না। ভুলে যায় না জীবন ঘনিষ্ঠ স্মৃতিও। আমিও ভুলতে পারিনি ছোটবেলার বন্ধুদের মতো স্মৃতির মনিকোঠায় ভাস্বর হয়ে থাকা মাধ্যমিক শিক্ষকদের। অনেক দিন ধরেই আমার পরিকল্পনা ছিলো, শ্রদ্ধেয় মাধ্যমিক শিক্ষকদের রসাত্মক স্মৃতি নিয়ে একটি লেখা লিখবো। কিন্তু প্রথম দিকে আগ্রহ থাকলেও ব্যস্ততার কারণে আমার পক্ষে লেখা সম্ভব হয়নি। তবে শিক্ষকদের অবদানের কথা স্মরণ করেই তাঁদের স্মৃতি কথা লিখতে অনুপ্রাণিত হই। তাঁদের অবদানের কথা মনে করে লেখাটি শেষ করতে পেরেছি। শিক্ষকদের স্মৃতি লিখতে পেরে নিজেকে অনেকখানি ধন্য মনে করছি।

আমরা ১৯৮৬ সালে ইখড়ি কাটেঙ্গা ফজলুল হক পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। আমরা প্রায় সাড়ে ৬ বছর এই বিদ্যালয়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের নিকট থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করি। আমরা ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সাফল্যের সাথে কৃতকার্য হই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের শুরু থেকে ৩৮ বছরে এই শিক্ষকেরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। আমি স্মৃতিকথা লেখার শুরুতে স্মরণ করছি, অত্র বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক প্রয়াত হেমায়েত হোসেন চৌধুরী, সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রয়াত খান মোহাম্মদ আলী (তিনি অত্রস্থ অঞ্চলে সি,আই, মোহাম্মদ নামে সুপরিচিত), সাবেক সহকারী শিক্ষক মোঃ আশরাফ আলী, প্রয়াত মাওলানা এম আবদুল্লাহ, প্রয়াত এম বোরহান উদ্দীন, প্রয়াত এম, আবুল বাশার, মোল্যা ইমান উদ্দীন, প্রয়াত শান্তি রঞ্জন বিশ্বাস, সুভাষ চন্দ্র সরকার, রতন কুমার দাস, প্রয়াত গোলাম মোস্তফা ও প্রয়াত মোঃ রেজাউল হক। এ সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমাকে ও আমার বন্ধুদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে স্কুলে পড়িয়েছেন, মানুষ হতে সহযোগিতা করেছেন, সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিঃস্বার্থ ভূমিকা রেখেছেন ।

গল্পে গল্পে স্মৃতি বলা সহজ। কিন্তু স্মৃতি কথা লেখা দুরূহ। আমি স্মৃতি কথা লেখার চেষ্টা করছি মাত্র। দেখি মানস পটের স্মৃতি কতখানি সাবলীলভাবে লিপিবদ্ধ করতে পারি। লেখাটি সফলভাবে শেষ করতে পারলে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে কৃতার্থ থাকবো। স্মৃতিকথা লেখার পূর্বে একটি কথা বলতে চাই, শ্রদ্ধেয় কোন স্যারকে ব্যক্তিগতভাবে ছোট করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মানসে এই লেখার কোন উদ্দেশ্য নয়। বরং তাঁদের প্রতি যথার্থ সম্মান রেখে, শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত করে, তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখাই আমার এই লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য। স্মৃতি কথা লেখার শুরুতে আমার কাছে প্রথমে ভেসে উঠছে হাসিমাখা মুখটি। এই হাসিমাখা মুখটি হলেন, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মোঃ রেজাউল হক। তিনি আমাদের বাংলা বিষয় পড়াতেন। তিনি ১৯৯৯ সালে প্রয়াতের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। অবর্ণনীয় অর্থনৈতিক সংকট থাকা সত্তে¡ও কখনও তাঁর মুখ অনুজ্জ্বল ছিল না। আমাদের বুঝতে পারতাম, তাঁর সংসার পরিচালনা করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। কিছুটা অর্থসংকট দূর করার মানসে আমাদের প্রাইভেট পড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও প্রকাশ্যে তিনি বলতে পারতেন না। আগ্রহের বিষয়ে তিনি নীরব ভ‚মিকা পালন করতেন। আমি মোটামুটি উপলব্ধি করতাম স্যার আমাদের পড়াতে চান। কিন্তু স্যার আমাদের বলতে পারছেন না। প্রাইভেট পড়ার ব্যাপারে প্রতি বছর আমিই স্যারকে বলতাম, সামনে আমাদের পরীক্ষা। বন্ধুরা গল্প ও কবিতা ভালো করে বুঝতে পারছে না। তাই আপনি যদি প্রাইভেট পড়াতেন তাহলে আমার বন্ধুদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সুবিধাজনক হতো। এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিটা রেজাউল স্যারের জন্য অনুক‚লে ছিল। আমার এই প্রস্তাবে স্যার খুব খুশী হতেন। নিশ্চিত হবার জন্য বলতেন, এটা তোমার কথা নাকি তোমার বন্ধুদের কথা। বন্ধুরাই আমাকে বলেছে, এটা নিশ্চিত জানার পর আনন্দের সাথে বলতেন, প্রাইভেট আগামীকাল থেকে পড়াবো। প্রাইভেট পড়ানোর সময় প্রবন্ধ, গল্প বা কবিতার নোট তৈরী করার সময় স্যার সুনির্দিষ্ট কিছু শব্দ ব্যবহার করতেন। শব্দগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, দৃষ্টিপাত, আলোকপাত ও জ্ঞাতার্থে। এই শব্দগুলো এখনও আমাদের বন্ধুদের ঠোঁটে-ঠোঁটে রয়ে গেছে। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন তাঁর চিন্তা ভাবনার মধ্যে ছিলো না। স্যার আমাদের প্রাইভেট পড়াতেন সত্য, তবে গণহারে বাণিজ্যিকভাবে ছাত্র পড়াতেন না।

আমাদের আরেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বাংলা পড়াতেন। ইখড়ী নিবাসী এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের নাম এম. বোরহান উদ্দীন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে উত্তর খুলনার মুক্তিবাহিনীর দলীয় প্রধান ছিলেন। তিনিও না ফেরার দেশে চলে গেছেন ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর। সহকর্মী হলেও আমাদের প্রয়াত পিতা হেমায়েত হোসেন চৌধুরীর সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পল্লী গ্রামে থেকেও এমন ছান্দনিক কবিতা লিখতেন যার জুড়ি মেলা ভার। ১৯৮৬ সালের কথা। তখন আমরা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। বোরহান স্যার বাংলা পড়ানোর জন্য আমাদের ক্লাসে প্রবেশ করলেন। শিক্ষক আসনে বসে বোরহান স্যার বললেন, আজ কি পড়া? কোনো কোনো বন্ধু বললো, প্রবন্ধ স্যার। স্যার বললেন, প্রবন্ধের নাম কি? বন্ধুরা বললো, ‘যৌবনে দাও রাজটীকা’। বোরহান স্যার আবার বললেন, প্রবন্ধটি কে লিখেছেন? বন্ধুরা বললো, প্রমথ চৌধুরী। কোনো প্রশ্ন পড়া দিয়েছি কী ? আমাদের দিকে তাকিয়ে বোরহান স্যারের জিজ্ঞাসা। বন্ধুরা সমস্বরে বললো, হ্যা স্যার, একটি প্রশ্ন দিয়েছেন। প্রশ্নটি হলো, লেখক কাদের যৌবনে রাজটীকা দেওয়ার কথা বলেছেন, কেন বলেছেন? বিস্তারিত বিবরণ দাও। বোরহান স্যারের সরাসরি জিজ্ঞাসা, কে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে ? আচ্ছা তুমিই বলো। এই বন্ধুটি মনে মনে ভাবছে, কোনদিন তো পড়া পারি না। স্যার প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতে আমি অক্ষম। উর্বর মস্তিষ্কের কারণে আমার পড়া মনে থাকে না। তবে এই প্রশ্নটি আমার জন্য সহজ। তাই বন্ধুটি দ্রুত গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, স্যার এ প্রশ্নের উত্তর হেভি সহজ। স্যার বললেন, তাই-ই। সহজ যদি হয়, তাহলে দ্রুত গতিতে বলে ফেলো, ব্যাটা। এবার বন্ধু বলেই ফেললো, ৯নং প্রশ্নের উত্তর দেখ। বোরহান স্যার অবাক বিষ্ময়ে বললেন, কী বললে? বন্ধু আবার জোরে বললো, ৯নং প্রশ্নের উত্তর দেখ। বন্ধুর এ ধরণের উদ্ভট উত্তরের জন্য স্যার প্রস্তুত ছিলেন না। বোরহান স্যার এবার বললেন, এই, আমার এ দিকে আয়। বন্ধুটি স্যারের নিকট অগ্রসর হলো। স্যার আবার বললেন, উত্তরপত্র নিয়ে আয়। বন্ধু উত্তরপত্র নিয়ে এলো। স্যার বললেন, উত্তরপত্রটি বের কর। বন্ধুটি উত্তরপত্রটি বের করলো। স্যার বললেন, ৯নং প্রশ্নের উত্তর দেখ কোথায় আছে? আমাকে তা দেখাও। বন্ধুটি স্যারকে দেখিয়ে বললো, এইখানে যে লেখা আছে ৯নং প্রশ্নের উত্তর দেখ। তখন বিষয়টি বুঝতে পেরে বোরহান স্যার হাসলেন। বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করলো, স্যার আপনি হাসছেন কেন? স্যার বললেন, হাসবো না আবার। হাসছি এই কারণে, তোমার বোকার মতো ভাবনার জন্য। ৯নং প্রশ্নের উত্তর দেখ এর অর্থ হলো এই- ৩নং প্রশ্ন এবং ৯নং প্রশ্ন দুটি একই রকম, তাই দুটি প্রশ্নের উত্তর এভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বন্ধুকে বোঝানোর জন্য বোরহান স্যার তাকে ৩নং প্রশ্নের উত্তর বের করে দেখিয়ে বললেন, ৩নং প্রশ্ন আর ৯নং প্রশ্ন একই রকম বা কাছাকাছি। ফলে লেখক তার বইয়ে ২টি প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্নের সমাধান লিখেছেন অন্যটি এভাবে নির্দেশ করেছেন, যাতে পৃষ্ঠা অপচয় না হয়। বন্ধু এবার তার বোকামীর জন্য অনুতাপ করলো। বন্ধুটি বলেই বসলো, স্যার এতো বড় প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করা আমার কর্ম নয়। বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দিতে যেয়ে আমারই তো তাক লেগে গেছে। বন্ধুটি দ্রুত তার আসনে চলে গেল। সভ্য বালকের মতো বন্ধু শব্দহীন থাকলো।

সপ্তম শ্রেণিতে আমাদের গণিত পড়াতেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রতন কুমার দাস। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম মধুমঙ্গল। বন্ধু সুধাংশু’র আপন ভাই। সে খুবই সহজ-সরল, অনেক ক্ষেত্রে বহু কথা অকপটে প্রকাশ করে ফেলে। পড়াশোনার প্রতি একটু ঝোক কম। ফলে পড়াশোনা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য রতন স্যার মধুকে উদ্দেশ্যে করে বলতেন, ভাত খেয়ে যা’ মধুমঙ্গল, ভাত খাইয়ে যা’ মইধ। অর্থাৎ এই উক্তির উদ্দেশ্য হলো- পড়াশোনা করে মানুষ হতে পারলে, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উঁচু অবস্থানে যেতে পারলে, মা-ও ভালো চোখে দেখে। তখন সন্তানের নামটিও সঠিকভাবে বলেন। শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করেন। এভাবে মন্তব্য করেন স্যার রতন কুমার দাস।

মাধ্যমিক শিক্ষকদের মধ্যে লম্বা ও সুঠামদেহের অধিকারী ছিলেন মাওলানা এম আব্দুল্লাহ। তিনি আব্বুকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। নিজের স্যার বলে অভ্যাগতদের নিকট পরিচয় দিতেন। এতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আবদুল্লাহ মাওলানা কে আমরা হুজুর স্যার বলে সম্বোধন করতাম। তিনি আমাদের ধর্ম পড়াতেন। তিনি জীবদ্দশায় দুই বার হজ্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয়বার হজ্ব পালন করতে যেয়ে তিনি ১৯৯৭ সালে সৌদি আরবে মৃত্যুবরণ করেন। জেদ্দায় তাঁকে সমাধিস্ত করা হয়। ধর্ম শিক্ষক হলেও তিনি রসাত্মক মানুষ ছিলেন। ধর্ম পড়াতে এলে তিনি মাঝে মধ্যে শিক্ষণীয় গল্প বলতেন, যদিও গল্পগুলো ছিলো খুবই ছোট। একদিন ধর্ম পড়ানোর পর বন্ধুরা আব্দুল্লাহ মাওলানা স্যারকে বললো, হুজুর স্যার, আজ আমাদের একটি গল্প বলুন। না, না আজ ক্লাস শেষ, সময় নেই, আগামী ক্লাসে বলবো। বন্ধুরা নাছোড়বান্দা। না, না, স্যার আজ বলতেই হবে। নিরুপায় হয়ে হুজুর বললেন, ঠিক আছে, বলছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষক বাংলা পড়ানোর জন্য ক্লাসে প্রবেশ করলেন। ক্লাসে প্রবেশ করেই ছাত্রদের বললেন, তোমরা পড়ো, এইভাবে দিন চলে যায়, মাস চলে যায়। শিক্ষকের সাথে ছাত্ররাও বলা শুরু করলো, এইভাবে দিন চলে যায়, মাস চলে যায়। পড়াতে পড়াতে এই শিক্ষক ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে পড়া তার অভ্যাসগত বিষয় ছিলো। এভাবে তিনি প্রতিদিন ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়তেন। কিছুক্ষণ পর অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে দেখা করার জন্য দুজন ব্যক্তি ঐ ক্লাসের বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন ঐ দুই ব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, ছাত্ররা কি পড়ে। মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বুঝতে পারলেন, ছাত্ররা পড়ছে, এইভাবে দিন চলে যায়, মাস চলে যায়। তখন ঐ দুই ব্যক্তির একজন ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এইপড়া কে পড়তে বলেছেন? ছাত্ররা বলে উঠলো, আমাদের স্যার পড়তে বলেছেন। এই পড়া পড়তে পড়তে দেখি স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন। আচ্ছা, এখন তোমরা পড়ো , এভাবে আর কয়দিন যাবে? ছাত্ররা তখন বললো, আচ্ছা, আমরা যদি এই পড়া পড়ি, আর স্যার উঠে আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, কে এই পড়া পড়তে বলেছেন, তখন আমরা কি বলবো? ব’লো, এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বন্ধু পড়তে বলেছেন। এই কথা বলে, ঐ দুই ব্যক্তি প্রধান শিক্ষকের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। ছাত্ররা পড়তে লাগলো, এভাবে আর কয়দিন যাবে? এভাবে আর কয়দিন যাবে? হঠাৎ করে স্যারের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। স্যার পড়া শুনছেন মনোযোগ দিয়ে। শুনছেন আর অবাক হচ্ছেন। পড়তে দিলাম, এইভাবে দিন চলে যায়। অথচ ছাত্ররা পড়ছে, এইভাবে আর কয়দিন যাবে? স্যার তো ছাত্রদের ওপর ভীষণ রেগে গেলেন। উচ্চকণ্ঠে স্যার বললেন, এই তোমরা উল্টোভাবে পড়া পড়ছো কেনো? তোমাদের এই পড়া কে পড়তে দিয়েছেন ? তখন ছাত্ররা বললেন, স্যার আমাদের স্কুলের হেড স্যারের এক বন্ধু এই পড়া পড়তে দিয়েছেন এবং তিনি স্যারের সাথে দেখা করতে গেছেন। এই কথা শোনামাত্র বাংলা শিক্ষক রীতিমত ঠান্ডা হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবছেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। আচ্ছা, আচ্ছা, তোমরা বসো, আমি বিষয়টি দেখছি? এই বলে তিনি ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন , আর মনে মনে ভাবছেন, ছাত্রদের কাছে তো ভাব নিলাম, কিন্তু আমার কি হবে? চাকরী ঝুলে যাবে না তো? বাড়ী থেকে বেরোলেই ছায়া লাগত তাঁর।

ছায়া না থাকলে বাড়ী থেকে বেরোতে কষ্ট হতো স্যারের। এই স্যার হলেন, মোঃ আশরাফ আলী। তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। স্যার শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন। বাড়ী থেকে হেঁটেই আসতেন স্কুলে। স্যারের মাথায় ছাতা থাকতো না। ছাতার বদলে সংবাদপত্র মাথার ওপর ধরে স্কুলে প্রবেশ করতেন। তিনি শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে বলতেন, আজ কি পড়া? সমস্বরে বলতাম, স্যার…. পড়া। ….. আছিস? ইয়াস স্যার, উপস্থিত স্যার। আশরাফ স্যার বলতেন, বলার কী ছিরি রে বাবা। হবে ইয়েস স্যার, বলিস ইয়াস স্যার, মানেটা কি ? মানেটা স্যার স্বাভাবিক, ইয়াস স্যার, মানে উপস্থিত। বাগাড়ম্বর না করে স্যার বলতেন, আচ্ছা বসো। ঝামেলা বাড়াস না। আচ্ছা আসলাম, মাহমুদ পড়া করে এসেছো। জ্বী স্যার। কী রকম পড়া করেছো? টেবিলের সামনে এসো । আসলাম, মাহমুদ দুজনে টেবিলের সামনে এলো। স্যারের উক্তি- পড়ো দেখি, কতদূর পারো? পড়া শুরু করলো, মাঝে বেধেও গেল। আবার পড়া শুরু করলো, আবার সামান্য বেধেও গেল। স্যার বললেন, আমার কাছে এসো। আর একটু কাছে এসো। এবার স্যার নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। কলি ধরলেন। কলি ধরে সজোরে টান দিলেন। আসলাম আর মাহামুদ বললো, স্যার কলি টানলে ব্যথা লাগে। মাথা টন-টন করে। কলি টানার কারণ, ব্যথাও পেল, আবার বাসায় পড়ার জন্য স্মরণও থাকলো। দস্যি নয়, নস্যি। তাঁর কাছে পানের মতো জরুরী ছিল নস্যি। নস্যি ছাড়া চলতেই পারতেন না তিনি।

নস্যি বহনকারী এই স্যার হলেন, সুভাষ চন্দ্র সরকার। আমাদের ইতিহাসের শিক্ষক। প্রায় প্রতিদিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম। দূর থেকে দেখতাম সুভাষ স্যার আসছেন। বিদ্যালয় ভবন থেকে বিশ হাত দূরে থাকা অবস্থায় সুভাষ স্যার বলতেন, এই তোমরা দূরে থাকো। তোমরা দূরে থাকো। আমার সাইকেল দুর্ঘটনায় কবলিত হবে। কেন স্যার, কেন স্যার ? আমার সাইকেলের ব্রেক নাই। এই অকেজো ব্রেক নিয়ে স্যার সাইকেল চালিয়েছেন বহুদিন। স্যারের সাইকেল এর গঠন এমন যে, অনেকের ঐ সাইকেল চালানোর সাধ্যি নেই। হঠাৎ করে সুভাষ স্যার একদিন হেঁটে আসছেন স্কুলের দিকে। স্কুল মাঠ পেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। স্যারের হেঁটে আসার জন্য সকলে একটু অবাক হলো। আমি অনুমান করে বললাম, খুব সম্ভবত স্যারের সাইকেল চুরি হয়ে গেছে। অন্য সকলে বলে উঠলো- এটা অসম্ভব। কারণ স্যারের সাইকেল চালাবে এমন দক্ষ চালক এই তেরখাদায় নেই। খুব সম্ভবত অন্য কোন সমস্যা হয়েছে। এমনকি সাইকেলটি অকেজো হতে পারে। এই কথা বলতে বলতে স্যার আমাদের কাছে চলে এলেন। স্যারকে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার আপনি হেঁটে এলেন কেন? স্যার হেসেই বলে ফেললেন, আমার সাইকেল চুরি হয়ে গেছে। কে যে সাইকেলটি নিল বলতে পারছি না। তবে যে-ই সাইকেলটি চুরি করুক না কেন আমার এই সাইকেলটি সুন্দরভাবে কেউ চালাতে পারবে না। হঠাৎ একদিন বিদ্যালয় চলাকালীন পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে যায়। বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ছাত্রদের উপস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। অভিভাবকরাও ছাত্রদের সাথে যুক্ত হন। তাদের সংখ্যাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। আমরাও ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসি। আমরাও এই ছাত্রদের সাথে যুক্ত হই। এসে দেখি প্রধান শিক্ষকের কক্ষেও কিছু ছাত্রদের তাপ উত্তাপ চলছে। ছাত্ররা বেশ ক্ষুব্ধ। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির কোন সদস্য তখন উপস্থিত ছিলেন না। এক পর্যায়ে আমরা জানতে পারলাম, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শান্তি রঞ্জন বিশ্বাস নবম শ্রেণীতে পদার্থবিজ্ঞান বিষয় পড়াচ্ছিলেন। তিনি পাঠ গ্রহণের সময় একজন নাম না জানা ছাত্র পড়া প্রদানে ব্যর্থ হলে রাগান্বিত হয়ে এবং অনিচ্ছা সত্তে¡ও ছাত্রের দিকে আকস্মিক ডাস্টার ছুড়ে মারেন। এতে ঐ ছাত্রের কপাল ক্ষতবিক্ষত হয়। কপাল রক্তাক্ত হয়। পরিস্থিতি বেশ অস্থিতিশীল দেখে আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও আমাদের প্রয়াত পিতা হেমায়েত হোসেন চৌধুরী শান্তি স্যারকে সকলের সামনে দুঃখ প্রকাশ করতে বলেন। কিন্তু শান্তি স্যার আব্বুর পরামর্শে রাজি হননি। শান্তি স্যার বললেন, আমি একজন শিক্ষক, পড়া না পারলে আমি আমার ছাত্রকে বেত্রাঘাত করতে পারি, ধমক দিতে পারি। এজন্য কেন আমি দুঃখ প্রকাশ করবো? আব্বু তৎক্ষণাৎ বললেন, আপনি তো বেত্রাঘাত করেননি, এমন কি ধমকও দেননি। সময় যাচ্ছে, পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে। কিন্তু শান্তি স্যার নির্বিকার। আব্বু অবিরত বলার পরও শান্তি স্যার পূর্বের অবস্থানে অনঢ়। নিরুপায় হয়ে আমার আব্বু পল্লী চিকিৎসক রমেশ ডাক্তারকে ডেকে আনেন। রমেশ কাকা এসে ঐ ছাত্রকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। ক্ষতবিক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ করে দেন। ফলে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে গেল। তখন পরিস্থিতি শান্ত হবার পথে। এ রকম অবস্থায় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরাও হন্তদন্ত হয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে এলেন। তারা আক্রান্ত ছাত্রকে দেখলেন। সুস্থ আছে, ভালো আছে, রক্তাক্ত অবস্থায় নেই। তবুও ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন তোমার শারীরিক অবস্থা কি? তুমি সুস্থ আছো তো? উত্তরে ঐ ছাত্র বললো- আমি সুস্থ আছি। হেড স্যারই আমাকে চিকিৎসা করিয়েছেন। তখন ক্ষুব্ধ হয়ে ছুটে আসা সদস্যরা শান্ত ও স্বাভাবিক হলেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্র ও অভিভাবকদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন, হেড স্যারের উপস্থিত বুদ্ধিতে শান্তি স্যার আজ বেঁচে গেলেন।# লেখক: মুনীর চৌধুরী সোহেল, আহবায়ক, গণসংহতি আন্দোলন খুলনা জেলা।

এই সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায় সিসা হোস্ট