নিহাল খান,রাজশাহী……………………………………………………
রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধের ধারে ভাঙ্গাচোরা ছোট্র একটি জরাজীর্ণ ঘর। শীতের তীব্রতা হানা দিচ্ছে বস্তির এই ঝুপড়ি ঘরে।স্বাধীনতার ৫১ বছরেও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা জলিল শাহ’র স্ত্রীর অসুস্থতা নিয়েই খেয়ে না খেয়ে এই ঘরে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে, অর্থাভাবে করতে পারছেন না চিকিৎসা।
১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনের সব কিছু হারিয়ে দুঃখ-কষ্ট নিয়েই অসহায় জীবন কাটাচ্ছেন নিঃসন্তান আনোয়ারা বেওয়া।আনোয়ারা বেওয়ার বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর দেয়া দুই হাজার টাকা ছাড়া বিজয়ের এতো বছর পরেও মেলেনি আর কোন সহায়তা। শীত তাঁর জীর্ণ শরীর নিস্তেজ করে দিলেও শরীরে উত্তাপ নেয়ার মতো বস্ত্র নেই তাঁর।টাকার অভাবে করাতে পারছেন না চোখের চিকিৎসাটাও।
রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারি এলাকায় বাদুরতলা বদ্ধভুমির পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় জরাজীর্ণ ছোট্র একটি ঝুপড়ি ঘরে অনাহারে-অর্ধাহারে কেটে গেছে তার অনেক বছর। বৃদ্ধ বয়সেও দু ‘বেলা দুমুঠো খাবারের জন্য অন্যের দুয়ারে ছুটে বেড়াতে হয় প্রতিনিয়ত। সহায় সম্বল বলতে নড়বরে ঘুনেধরা একটা চৌকি,থালাবাটি আর একটা বাক্স।জীবন যুদ্ধে হাপিয়ে পড়া প্রতিবেশির দয়ায় বেঁচে থাকা প্রায় ৮০ বছর বয়সী এই মানুষটি আজ বড় অসহায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বিয়ে হয়েছিল আনোয়ারা বেওয়ার।সে সময় সব কিছুই ছিল তার।স্বামী ব্যবসা করতেন।নগরীর তালাইমারি বাদুরতলা এলাকাতেই ছিল তার দোতালাবাড়ি।এসব এখন শুধুই স্মৃতি। স্বামীকে সুখে-শান্তিতেই দিন কাটছিল আনোয়ারার।কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন টেকেনি তার কপালে।
বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার লক্ষে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় মাত্র ৭ বছরের মাথায় পাকিস্থান হানাদার বাহিনীর বুলেট কেড়ে নেয় জলিল শাহের প্রান।নিমিষেই নিভে যায় আনোয়ারার সুখের প্রদীপ।সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে নিঃসঙ্গতায় আজো বেঁচে আছেন আনোয়ারা। দেশকে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছিল তার স্বামী জলিল শাহ। আর স্বামীকে ভালোবেসে বৃদ্ধ বয়সে আজো একা আনোয়ারা।
পাকিস্তানী হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচাতে স্ত্রীকে রেখে এসে ছিলেন দূর্গাপুরের এক আত্নীয়ের বাড়িতে। শেষ দেখায় বলেছিল,বঙ্গবন্ধুসহ দেশকে বাঁচাতে যাচ্ছি,হয়তো আর দেখা হবেনা। সেদিনের সেই কথাগুলো আজো স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে। জীবন জীবীকার তাগিদে এক সময় বাড়ি বাড়ি গিযে হোমিও ঔষধ বিক্রি করতেন বলে এলাকায় ডাক্তার নানী হিসেবেই পরিচিতি তার।বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই হতভাগিনীর জীবন গাড়ীর চাকা আজ থেমে যাওয়ার পথে।তাই প্রতিবেশীরাই তার প্রধান ভরসা।
স্বাধীনতার ৫১ বছরেও তার ভাগ্যে বয়স্ক ভাতা ছাড়া জোটেনি সরকারী বা বেসরকারী কোন অনুদান। মুক্তিযোদ্ধা নেতারা বলছেন, এখনি সময় আনোয়ারাদের জন্য কিছু করার।এসব অবহেলিতদের পাশে এসে দাঁড়াতে সরকার এবং বিত্তবানদের প্রতি আহবান তাদের। স্থানীয় আলম হোসেন জানান,এই বয়সে তিনি কারো বাড়িতে কাজ করতে পারে না।তাকে সাহায্য- সহযোগিতা করার মতো আপনজন কেউ নেই। তাই তিনি যেন সরকারিভাবে সহায়তা পায় এ দাবি জানাই।
কান্নাজড়িত কন্ঠে আনোয়ারা বেওয়া জানান, আমার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।তার লাশটিও আমি দেখতে পারি নাই। কিন্তু আজও তাকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। এমনকি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে সরকার থেকে আমি কোনো সাহায্য-সহযোগীতা পাই না। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর সম্মানে দ্বিতীয় বিবাহ পর্যন্ত করেননি আনোয়ারা। তাই বৃদ্ধা বয়সে দেশপ্রেমিক স্বামীর উপযুক্ত মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। প্রমত্ত পদ্মার পানে শুধুই কি নিরবে নিভৃতে চেয়ে থাকা? বিজয়ের আনন্দ উল্লাস ধ্বনীতে হারিয়ে যাবে তার হাহাকার ? জলির শাহের মত লাখো শহিদের রক্ত দিয়ে কেনা বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা কি উড়বে না বস্তির এই জরাজীর্ন কুড়ে ঘরে?#