আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী…………………………………………………..
নদীতে মাছ ধরে সংসার চলছেনা জেলেদের। অনেকেই বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পেশা। নদীই যাদের জীবিকার প্রধান উৎস্য, তাদের অনেকের এখন অনিশ্চিত জীবন। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জেলেদের। এছাড়া ঋণের কিস্তি তো আছেই। যার ফলে নদীতে জেলেদের প্রাণের স্পন্দন টের পাওয়া মুশকিল। এমনটায় রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মার চরের জেলে পাড়ায়।
নিজের জাল, নিজের নৌকা। নিজেই মাছ ধরেন। কিন্তু নদীতে মাছ না পেয়ে হতাশায় জেলে আতিয়ার রহমান। নিষেধাজ্ঞার ২২দিন নদীতে মাছ ধরার আগে ঋণ করেছেন ৩০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে সংসারে খরচসহ জাল ও নৌকা মেরামতের কাজ করেছেন। ধারনা করছিলেন নদীতে ধরা মাছ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবেন। কিন্তু নদীতে মাছ মিলছেনা। সারাদিনে যে মাছ পান, তাতে নৌকার ইঞ্জিনের তেলের খরচ আসেনা। তাই নদীতে নামছেন না। তার দলে যে ২জন ছিল, তারা এলাকার বাইরে কাজে গেছে।
জেলে আজগর আলী সেখ বলেন, নিজের জাল ও নৌকা নেই । অন্যের সঙ্গে ভাগে মাছ ধরার সুযোগ পাওয়ার আশায় বসে থাকতে হয় তাকে। কিন্তু নদীতে জাল ফেলেও মাছ পাচ্ছেন না। খেয়াজাল নিয়ে মাছ ধরার জন্য নদীর পাড়ে ঘুরছিলেন জেলে জামাল উদ্দীন।সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কোন মাছই পাননি তিনি।
জেলে শাকিম আলী বলেন,নদিতে মাছ নাই।সারাদিন জাল ফেলে যে মাছ পান তাকিয়ে নিজের পেট চলেনা।বউ বাচ্চাকে খাওয়াবো কি? এ অবস্থা চলতে থাকলে বাড়ীর সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।
নদীর পাড় দিয়ে যেতে দেখা গেল, কয়েকজন জেলে, জাল নিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দলনেতা জেলে মালেক বেপারি জানালেন, বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি যখন স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, আর সেই পানিতে যখন মাছ আসে, তখন নদীতেই সারা দিন কাটে তাদের। অন্য সময় কখনও হয়তো ভাড়ায় মাছ ধরতে যান কোনো পুকুর বা ঘেরে, অথবা কামলা খাটেন।
কোষা নৌকায় ভেসে কচাল পাতেন, মাইজাল ফেলে মাছ ধরেন কিশোরপুর গ্রামের জেলে অদৈত্য হোলদার। ভাগে মাছ ধরে কখনো ৩০০,কখনো ৫০০শ’ টাকা পান । কার্তিকের পর পানি নেমে গেলে সে সুযোগও চলে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কার্তিক গেলেই জাত জেলে হয়ে পড়েন, পর নির্ভরশীল কামলা।
১৪ নভেম্বর সোনবার রাজশাহীর পদ্মার চরাঞ্চলের চকরাজাপুরে কালিদাশখালি এলাকার নদী পাড়ে গিয়ে দেখা গেল, কয়েকটা নৌকা নদীর পাড়ে তুলে রাখা। দুপুর পৌণে ২ টায় পাওয়া গেল ওই গ্রামের জেলে মজনু ফকিরকে। তেমন মাছ না পেয়ে মলিন মূখে ডোঙা নৌকা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।
তাকে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, রাত ৩টায় ডোঙা নৌকা নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে নেমেছিলেন। ১০০ গ্রাম ওজনের দেড় কেজি ইলিশ মাছ পেয়েছেন । বাজারে যা বিক্রি হবে ৫০০ থেকে ৬০০শ’ টাকায়। আর যে দিন মাছ পাননা, সেদিন সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারেননা। মাছ পওয়া যায়না বলে তার দলের ২ জেলে নদীতে নামেননা। তারা এখন অন্য পেশায় কামলা খাটেন।
জেলে মজনু ফকিরের ৪ সদস্যর সংসার চলে নদীতে ধরা মাছ বিক্রি করে। নিবন্ধিত জেলে হলেও সরকারের দেয়া কোন প্রণোদনা পাননি তিনি। তিনি আরো বলেন, জিনিস পত্রের যে দাম, তাতে মাছ ধরে সংসারের কোন চাহিদা মেটাতে পারছেন না। দিন দিন নুন আনতে পাতা ফুরবার মতো অবস্থা।
কালিদাশখালি গ্রামের নদীর পাশের বাড়ি জেলে আতিয়ার রহমানের। বয়স ৩৫ বছর হবে। নিজের আয়ে সংসার চলে না বলে ১৩ বছর বয়সের ছেলে মজনু রহমানকে সেলুনে কাজে লাগিয়েছেন। ১৮ বছর বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ১ বছর আগে । ছোট ছেলে শান্ত ৪র্থ শ্রেণীতে লেখা পড়া করে। তিনি জানান, প্রনোদণার ২৫ কেজি চাল পেয়েছিলেন, নিষেধাজ্ঞার শেষ সময়ের দিকে। কিন্তু তার মতো চাল পাওয়া জেলের সংখ্যা হাতে গোনা।
রাজশাহী মৎস্য অধীদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৩০৫ জন। এর মধ্যে ইলিশ আহরণকারি জেলের সংখ্যা ৮৮৫ জন। প্রনোদনা পেয়েছেন মাত্র ৭৫৫ জন।
এলাকার জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওলিউর রহমান বলেন, চরাঞ্চলে নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৩৬০ জন। এর বাইরেও অনেক জেলে রয়েছে। নদীতে মাছ না পাওয়ায় অনেকে বাধ্য হয়ে এলাকার বাইরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।
ইউপি চেয়ারম্যান ডি এম বাবুল মনোয়ার বলেন, এই গাঁয়ের ৩ ভাগের ২ভাগ ঘর-গৃহস্থালির সবটাই নদীতে। ভাঙনের কবলে পড়ে অনেকের মতো জেলেরাও ভিটে মাটি হারিয়েছেন। তারা এখন মানবতার জীবন যাপন করছেন।
তিনি আরে বলেন, নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ ২৪৬ জনের জেলের তালিকা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সরকারি কোন সহায়তা পাওয়া যায়নি।তিনি তার সাধ্যমত তাদের সহায়তা করছেন ।#