বিশেষ প্রতিনিধি……………………………………………
বাঙালীর সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে মেলার গন্ধ। কখনও ঋতু কখনও কৃষি কখনও নববর্ষ কখনও ঈদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মেলা। রাজশাহীর বাঘায় এমন একটি পল্লী মেলার ইতিহাস প্রায় ৫শ’ বছরের। পবিত্র ওরস উপলক্ষে প্রতিবছর ঈদে অনুষ্ঠিত হয় বাংলার ঐতিহ্যবাহি মেলা। ঈদের দিন থেকে এবার মেলার অনুমতি মিলেছে ১৫ দিন। বছর ঘুরে ঈদের সাথে বাড়তি উৎসবে মেলার আড্ডায় ফিরে যাওয়ার আমেজে বাঘাসহ আশেপাশের উপজেলার মানুষ আনন্দে মাতোয়ারা। মেলায় বিভিন্ন পণ্যর পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। সব শ্রেণীর মানুষের প্রাণের ছোঁয়ায় মিলন মেলায় পরিনত হয় এই মেলা। তবে অনুষ্ঠিত মেলা নিয়ে রয়েছে মেলা কথা।
এবার স্বস্ত্রীক বাঘায় এসেছেন নাটোরের বড়াইগ্রামের শাহাজান ফকির। বাঘা মাজার এলাকায় কথা হলে ৭০ বছর বয়সের শাহাজান ফকির বলেন, ওরস উপলক্ষে বাঘায় এসেছেন ২৭ রমজানের দিনে। তার দুলা ভাইয়ের সাথে বাঘার মেলায় প্রথম এসেছিলেন ১০ বছর বয়সে। পরে কয়েকবার এসেছেন বন্ধুদের সাথে । বিবাহিত জীবনে এসেছেন সস্ত্রীক। প্রথম যেবার এসেছিলেন,সেই সময়ে এসেছেন পায়ে হেটে। তখন দেখেছেন মাজার এলাকার আশ পাশে জঙ্গলে ভর্তি। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওরসে আশা লোকজনে পরিপূর্ন ছিল মাজার এলাকা। এবার এসছেন যানবাহনে। দেখছেন অনেক কিছুর পরিবর্তন। তার মতো পাবনার সাথিয়া উপজেলার খেতুপাড়া গ্রাম থেকে এসেছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আরশেদ আলী। তার বয়স হয়েছে ৮১ বছর। চাকরি জীবনে কয়েকবার এসেছেন। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়ে এর আগেও এসেছেন ঈদের নামাজ আদায় ও ওরসে যোগ দিতে। আগে দেখেছেন ২৭/২৮ রমজান থেকে লোকজন আসতো ওরস ও ইদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য। তিনি জানান, তার চোখেও এখন অনেক পরিবর্তন দেখছেন ।
জানা যায়, আরবি শওয়াল মাসের ৩ তারিখ হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রঃ) ও তার ছেলে হযরত আব্দুল হামিদ দানিশমন্দ (রঃ) এর ওফাত দিবস উপলক্ষে, ধর্মীয় ওরস মোবারকের আয়োজন করেন মাজার পরিচালনা কমিটি। ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়সহ দেশের দুর দুরান্তের ধর্মপ্রাণ মুসলমান (নারি-পুরুষ) ও পাশর্^বর্তী দেশ ইন্ডিয়া থেকেও দল বেঁধে অনেক নারি-পুরুষও যোগ দেন ওরস উৎসব অনুষ্ঠানে। তারা বছরের এই সময়টা বেছে নেন, এপারের স্বজনের সাথে দেখা করার জন্য। ধর্মীয় উৎসবে সব সম্প্রদায়ের মানুষের পদচারনায় রুপ নেয় মিলন মেলায়। করোনার সক্রমন এড়াতে, ২০২০ সালের পর থেকে মেলা হয়নি। বিগত কয়েক বছর পর আবার মেলা হচ্ছে।
মেলার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ৬৭ বছরের সেকেন্দার আলী জানান, ছোট বেলায় পুতুল নাচ,বাইশস্কোপ দেখাসহ তাল পাতার ও বাঁশের বাঁশি কেনা আর সন্ধ্যার পর নাটক-যাত্রা গান শোনার জন্য দলবেঁধে মেলায় আসতাম। হ্যাচাক লাইট জ¦ালিয়ে চলতো রাতের উৎসব। কুপি বাতি জ¦ালিয়ে বসতো জুয়ার আসর।
মেলায় বেশীরভাগই দোকান ছিল মিষ্টান্ন, মৃৎ শিল্পীদের তৈরি মাটির হাঁড়ি পাতিল, নানার রঙের দেশীয়পশু-পাখী, শোলার খেলনা, খই, তালপাতার বাঁশি,বাঁশের বাঁিশ,ব্যাঙগাড়ি, বেতঁ-বাশের তৈরি সরঞ্জাম ইত্যাদি। মেলা থেকে বাবা কিনে নিয়ে যেতেন হাঁড়ি ভর্তি বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন। সেই সময়ে পোড়াবাড়ির চমচম আর গৌরপালের মিষ্টি ছিল সবার প্রিয়। খানকা বাড়ির মধ্যে রাতভর সামাকাওয়ালি,মারিফতি গানের আসর বসিয়ে জমিয়ে রাখতেন বাউল সন্যাসীরা। এখন মেলা হলেও মেলা থেকে আর তাল পাতার বাঁশি কেনা হয়ে উঠেনা। তার ভাষ্যমতে, ধর্মীয় এ মেলায় জুয়াসহ অশ্লিলতা বন্ধের দাবি রয়েছে স্থানীয়দের ।
ওয়াকফ এস্টটের আয়োজনে মেলা শুরুর পর থেকে তার কলেবর বেড়েছে বহুগুনে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বিভিন্ন পন্যর স্টল, প্রসারিত হয়েছে দর্শক-শ্রোতা-ক্রেতার ভিড়। ফুটপাতজুড়ে, সপিং মলের দোকানে বিক্রি হতে শুরু করেছে নানা ধরনের পণ্য, দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান-পাকিস্তানিসহ দেশি বিদেশি কাপড়ের বাহার। সার্কাস-নাগরদোলাসহ বিনোদনেসংগীতানুষ্ঠানের সংযোজনে এসেছে বৈচিত্র। অতিরিক্ত বিরক্তি নিয়ে কেউ-কেউ একে আর ঈদমেলা না বলে বাণিজ্যমেলা বলতেই চান।
মেলার সেকাল-একাল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বেসরকারি কলেজের প্রভাষক নবাব আলী বলেন, মানুষ বেড়ে গেছে, সে সঙ্গে বেড়েছে দর্শক-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর যেহেতু সাধারণ নাগরিকের প্রাত্যহিক বিনোদনের কিছু নেই, ঈদ এলে মেলাকে কেন্দ্র করে যে আয়োজন হচ্ছে, এটা ঈদের মেলা যতটা, তারও চেয়ে বেশি দোকানীদের উৎসব।
মেলায় আসার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নাট্যকার নির্মাতা ফিরোজ আহমেদ শিমুল সরকার বলেন, নব্বই দশকেও ঈদের আগে গ্রামের সব পরিবারের গায়ে উঠেনি নতুন পোশাক। দিনে দিনে গুছিয়ে রাখা টাকা দিয়ে মেলায় কেনাকাটা ছিলো মহা আনন্দের। ঈদের নামাজ পড়ে সমাজের সবাই মিলে খিচুড়ি খাওয়া আর দল ধরে ৫ মাইল দুরে পায়ে হেঁটে বাঘার মেলায় যাওয়াই ছিলো ঈদের মূল আনন্দ। একটু বিতৃষ্ণা নিয়েই বললেন, আগে ছিল প্রাণের ঈদ মেলা,এখন হয়েছে বাণিজ্য মেলা। আগের মেলা অবশ্যই অন্যরকম ছিল।
লালপুরের আব্দুল রশিদ মাষ্টার বলেন,একবার মেলা দেখার জন্য টাকা চেয়ে আব্বা দিয়েছিলেন দেড় টাকা। কান্নাকাটি করে সেই টাকা ছুড়ে ফেলে দিয়ে খালি হাতেই হাঁটা ধরলাম ১০ মাইল দুরে বাঘার মেলার রাস্তা। কত হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে। এখন রাস্তা ঘাট পাঁকা হয়েছে।
তবে অনাচারের কারণে এই মেলাকে ঘিরে আমার বেশ কিছু বাজে স্মৃতিও আছে। যাদের পদচারণায় ওরসে জমে উঠতো মেলা,এখন সেইসব বাউল-সৈন্যাসীসহ বহিরাগত যাত্রীদের পদচারণা অনেক কম। মেলাকে যারা দীর্ঘদিন নিজেদের জায়গা ভেবে এসেছেন, তাদের জন্য বিষয়টা আক্রান্ত করার মতোই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে মেলায় মিষ্টির দোকান নিয়ে বসেন স্থানীয় বাসিন্দা জামাল উদ্দীন । তিনি বলেন, কখনও ভাবিনি এখানে নিয়ম নীতি বিঘিœত হবে। তার ভাষ্য, আগে ওরসের জন্য খাস আদায় করতো মাজার কমিটি। পরে উন্মুক্ত ডাকে ইজারা দেওয়ায় হাত হিসেবে টোল আদায় হতো। এখন ১০০ টাকা স্কয়ার ফিট হিসেবে টোল নির্ধারন করা হয়েছে। নিয়মনীতি অনুসরন করে টোল আদায়ের দাবি তার।
বাজুবাঘা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মনোয়ারুল ইসলাম মামুন বলেন, বাঘা উদয়ন সংস্থার নাটকের অনুষ্ঠান ছিল মেলার বড় আকর্ষণ। এলাকার শিক্ষিত নাট্যশিল্পীরা বছর ধরে প্রস্তুতি নিতেন নাটকের। ক্রমে মেলার পরিধি বেড়েছে। ওয়াকফ্ এস্টেটের আঙিনা ছাড়িয়ে বাঘা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু আগের সেই প্রাণ যেন খুঁজে পাই না। বর্তমানে ধরন পাল্টেছে।
আব্দুল মজিদ নামে একজন বলেন, আগে হাঁটার জায়গা থাকত অনেক বেশি। মেলা সূত্রে মাত্রাতিরিক্ত দর্শক সমাগম আরও বেড়েছে। আগে বখাটে তরুণদের দুর্ব্যবহারের শব্দগুলো শুনতে হয়েছে। শর্ত ভঙ্গ করে খাজনা নেওয়ার অভিযোগও কম শুনতে হয়নি। তবে বর্তমান সময়ে নারিদের অবাধ পদচারনা পুরুষের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। এবার মেলায় বিনোদনসহ বিভিন্ন পণ্যর দোকান নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। শিশু থেকে শুরু করে দুর-দুরান্তের সব সম্প্রদায়ের শ্রেণী পেশার হাজার হাজার মানুষ আসছেন মেলায়। কেউ আসছেন মাজার,মসজিদ,যাদুঘর পরিদর্শনে। কেউ আসছেন মনোবাসনা পূরণে মানত নিয়ে,কেউ ওরসে যোগ দিতে। তবে বিনোদন প্রেমীসহ আবাল বৃদ্ধ বনিতা আর শিশুদের কোলাহলে সরগরম হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গন।
এবারও অশ্লিলতাবন্ধসহ ১০টি শর্ত বেঁধে দিয়ে ওয়াকফ্ এস্টেটের মাঠ ইজারা দিয়েছেন মাজার পরিচালনা কমিটি। ৪ এপ্রিল’২০২৪ উন্মুক্ত ডাকে ২৭ লাখ ৪০ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছেন বাঘা পৌর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মামুন হোসেন। ৮ লাখ টাকা বিডি জমা দিয়ে ডাকে অংশ নিয়েছিল ২০ জন।
সার্কাসসহ বিনোদনমূলক খেলাধূলার জন্য উপজেলা সদরে বাঘা মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ইজারা দিয়েছেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঈদের দিন থেকে ৮ দিনের জন্য ৫৫ হাজার টাকায় খেলার মাঠটি ইজারা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। উন্মুক্ত ডাকে ৫০ হাজার টাকার বিডি জমা দিয়ে অংশ নিয়েছিল ২০ জন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, গত ৫ এপ্রিল’২৪ বাঘা পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস সরকার মাঠটি ইজারা নিয়েছেন।
ওয়াকফ এষ্টেটের মাঠ ইজারা দিয়ে মাজারের আয় হয় লক্ষ লক্ষ টাকা। বিধি মোতাবেক আয়কর এর অংশ পান বাঘা পৌরসভা। বিগত বছরগুলোতে ১৫ দিনের অনুমতি নিয়ে মেলা চলেছে মানব্যাপি। অনেকে দোকান না উঠিয়ে মাসের পর মাস ব্যবসা করেছেন। আর ফায়দা লুটেছে মধ্যস্বত্বভুগিরা। পরে সেইসব দোকান উচ্ছেদ করা হয়। অশ্লিলতা বন্ধসহ যথানিয়মে ধর্মীয় ওরস অনুষ্ঠানের দাবি স্থানীয়দের। শর্ত মেনে মেলা চলবে বলে জানিয়েছেন ইজারাদার মামুন হোসেন।
প্রসঙ্গত ঃ প্রায় ৫০০ বছর আগে সুদূর বাগদাদ থেকে ৫ জন সঙ্গীসহ ইসলাম প্রচারের জন্য বাঘায় এসেছিলেন ধর্মীয় আদর্শের দিক-নির্দেশনার মহৎ পুরুষ আব্বাসীর বংশের হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রঃ)। বসবাস শুরু করেন, পদ্মা নদীর কাছে কসবে বাঘা নামক স্থানে। আধ্যাত্মিক শক্তির বলে ইসলাম প্রচারে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেন। শাহদৌলা (রঃ) ও তাঁর ছেলে হযরত আব্দুল হামিদ দানিশমন্দ (রঃ) এর সাধনার পীঠস্থান হলো বাঘা।
বাঘা ওয়াকফ এস্টেটের মোতয়াল্লী ও মাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম (রইশ) জানান, মূলতঃ ওরস ও ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়কে কেন্দ্র করে দেশের দুর দুরান্ত নারি পুরুষদের সমাগম ঘটে। যা মেলায় রুপ নেয়। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ৩শওয়াল শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রঃ) এর ৪৯৫ তম এবং তার ছেলে হযরত আব্দুল হামিদ দানিশমন্দ (রঃ) এর ৩৯৬ তম ওফাৎ দিবসে ওরস অনুষ্ঠিত হবে।
মাজার পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি উপজেলা নির্বাহি অফিসার তরিকুল ইসলাম বলেন, ধর্মীয় উৎসবের এই মেলায় কোন ধরনের অশ্লিলতা চলতে দেওয়া হবেনা। আগত দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।#