______ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার খবরটি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ২৫ ডিসেম্বর তার আগমনকে কেন্দ্র করে দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যে ব্যাপক প্রস্তুতি ও সংবর্ধনার আয়োজন চলছে, তা স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে এক বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। তার এই ফেরা কেবল বিএনপির জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা, জোটবদ্ধ রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিএনপির রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ও নেতৃত্ব তারেক রহমান সরাসরি দেশে উপস্থিত হয়ে দলের হাল ধরলে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
নেতৃত্বের একক কেন্দ্রবিন্দু: বর্তমানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করার চেয়ে সরাসরি উপস্থিত থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া কর্মীদের মনোবল বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত ও কার্যকর করবে।
তরুণ প্রজন্মের সম্পৃক্ততা: তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে দলের ভেতরে তরুণ নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। তিনি ফিরলে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বড় ধরনের রদবদল হতে পারে, যেখানে অভিজ্ঞদের পাশাপাশি শিক্ষিত ও দক্ষ তরুণদের জায়গা হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বনাম নতুন মেরুকরণ তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে অস্থিতিশীলতার শঙ্কা যেমন আছে, তেমনি নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনাও প্রবল।
জামায়াতের সাথে সম্পর্কের সমীকরণ: ২৫ ডিসেম্বর তিনি ফিরলে জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির সম্পর্ক নতুন কোনো মোড় নিতে পারে। ডানপন্থী ও রক্ষণশীল ভোটব্যাংক একত্রিত করতে জামায়াতকে সাথে নিয়ে একটি শক্তিশালী নির্বাচনী ব্লক তৈরি করার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশের রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ ঘটাবে।
অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি: আইনি চ্যালেঞ্জ ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অবস্থানের কারণে রাজপথে সংঘাতের ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে সুশীল সমাজের মতে, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির পথ সুগম হলে অস্থিতিশীলতা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আন্তর্জাতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব তারেক রহমানের ফেরা কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক: দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে অবস্থানের ফলে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে তার একটি নিবিড় যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তিনি ফিরলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার হতে পারে।
ভারত-বাংলাদেশ সমীকরণ: ভারতের সাথে বিএনপির ঐতিহাসিক দূরত্ব থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি একটি ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ পররাষ্ট্রনীতির কথা বলছে। তিনি ফিরলে ভারতের সাথে নিরাপত্তা ও ট্রানজিট ইস্যুতে নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকার: তারেক রহমানের ‘৩১ দফা’ তারেক রহমানের এবারের প্রত্যাবর্তনের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো তার প্রস্তাবিত ‘৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার’ রূপরেখা। চিন্তকমহল মনে করছেন, এটি কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনের একটি সনদ।
সংবিধান ও ক্ষমতার ভারসাম্য: এই ৩১ দফার মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা এবং উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন।
সুশাসন ও মানবাধিকার: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে একটি জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ার অঙ্গীকার এই রূপরেখায় ফুটে উঠেছে।
নতুন ধারার রাজনীতি: প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ গঠনের ধারণা সুশীল সমাজের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক প্রভাব ও নতুন অর্থনৈতিক দর্শন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সরাসরি অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে।
তারেক রহমানের আগমনে নিম্নোক্ত পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা যেতে পারে:
বিনিয়োগকারীদের আস্থা: রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হলে এবং একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি নিশ্চিত হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে।
রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণ: তারেক রহমান কেবল তৈরি পোশাক খাত নয়, বরং আইটি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বৈশ্বিক বাজারে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলেছেন।
স্বচ্ছতা ও সুশাসন: তিনি যদি দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি থেকে দূরে রেখে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেন, তবে বেসরকারি খাতে ব্যবসার খরচ কমে আসবে।
উপসংহার তারেক রহমানের ২৫ ডিসেম্বরের এই পরিকল্পিত আগমন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ। তার ফিরে আসা যেমন বিএনপিকে পুনরুজ্জীবিত করবে, তেমনি তার প্রস্তাবিত ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণে এক বিশাল ঢেউ তুলবে। জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতির নতুন সমীকরণ কিংবা একক শক্তিতে ঘুরে দাঁড়ানো—সবই নির্ভর করবে তার দূরদর্শিতার ওপর। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সাধারণ মানুষ গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে যে, তিনি কীভাবে একটি আধুনিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পথপ্রদর্শক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন!
#.. লেখক একজন শিক্ষক কবি গবেষক ও প্রাবন্ধিক