ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম
১. ভূমিকা: চুক্তির ঊর্ধ্বে সম্পর্কের ভিত্তি আমাদের সমাজে গৃহকর্মীরা এক অপরিহার্য সেবাদানকারী শক্তি। তাদের শ্রমের বিনিময়েই আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সহজ ও গতিশীল থাকে। সাধারণত, আমরা তাদের 'খালা', 'চাচী' বা 'বেটি'—এ ধরনের পারিবারিক ও স্নেহের সম্বোধনে ডেকে থাকি। এই সম্বোধনগুলো কেবল কথার কথা নয়, বরং এটি তাদের প্রতি আমাদের মনোজগতে এক প্রকার পারিবারিক বন্ধন স্থাপনের ইঙ্গিত বহন করে। পারিশ্রমিকের মাধ্যমে একটি আর্থিক চুক্তি সম্পন্ন হলেও, একজন মানুষকে নিছক 'শ্রমিক' হিসেবে বিবেচনা না করে, তাকে পরিবারের সদস্য বা নিকটজন হিসেবে গণ্য করাই আমাদের মানবিক ও সামাজিক কর্তব্য। এই নিবন্ধে, গৃহকর্মীদের প্রতি আমাদের পারিশ্রমিক ও চুক্তির বাইরে গিয়েও যে বিশেষ যত্ন, সম্মান এবং খাবারের মাধ্যমে মানবিকতা প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে, তার ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা হলো।
২. মূল আলোচনা: মানবিকতার প্রতিফলন খাদ্যের মাধ্যমে গৃহকর্মীর প্রতি আমাদের আচরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো খাবার ভাগ করে নেওয়া এবং সম্মানজনক খাদ্য পরিবেশন। এই মানবিকতাকে আপনার নির্দেশিত তিনটি দিক থেকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হলো:
ক. ধর্মীয় দিক: বরকত, সহমর্মিতা ও সুন্নাহ ইসলাম ধর্মে শ্রমিকের অধিকার এবং সেবাকর্মীর প্রতি সদ্ব্যবহারকে ইবাদতের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) শ্রমিকের পাওনা দ্রুত পরিশোধ এবং তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। গৃহকর্মীর ক্ষেত্রেও এই নির্দেশনা সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবি রাখে। খাদ্য ভাগ করে নেওয়া: আল্লাহর রাসূল (সা.) স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে: "যখন তোমাদের খাদেম (সেবক/গৃহকর্মী) তোমাদের জন্য খাবার তৈরি করে নিয়ে আসে... তখন তাকে নিজের সাথে বসিয়ে খাওয়ানো উচিত। আর যদি তাকে সাথে বসিয়ে না খাওয়ানো হয়, তবে অন্তত এক-দু’ লোকমা খাবার তাকে দিয়ে দেওয়া উচিত।" (সহীহ বুখারী, হাদিস: ৫৪৬০)। এটি প্রমাণ করে যে, খাদ্য প্রস্তুতকারীকে সেই খাদ্য থেকে অংশ দেওয়া আল্লাহর রাসূলের (সা.) সুন্নাহ।বরকত লাভ: কেবল উদ্বৃত্ত, নষ্ট বা ফেলে দেওয়ার মতো খাবার না দিয়ে যদি তাকে মাঝেমধ্যে ভালো ও বিশেষ খাবারও দেওয়া হয়, তবে এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ আপনার খাবারে বরকত (প্রাচুর্য ও কল্যাণ) দান করেন। এই বরকত কেবল খাদ্যের পরিমাণে নয়, বরং মানসিক শান্তি, আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং পারিবারিক সুখ-শান্তিতেও প্রতিফলিত হয়। ন্যায়পরায়ণতা: সেবাকর্মীর প্রতি সহানুভূতি ও অনুগ্রহ প্রদর্শনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
খ. সামাজিক দিক: সম্মান, সংবেদনশীলতা ও মানসিক তৃপ্তি গৃহকর্মীরা সমাজে প্রায়শই নিম্নবিত্ত বা সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের প্রতি আমাদের আচরণ সমাজের একটি বৃহত্তর অংশের প্রতি আমাদের মানবিক সংবেদনশীলতা প্রকাশ করে। সংবেদনশীলতা ও 'কষ': এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দিক। যখন গৃহকর্মী মাছ, মাংস বা বিশেষ কোনো খাবারের প্রস্তুতিতে সরাসরি অংশ নেন—তখন সেই খাবারের সুঘ্রাণ তাদের নাকে যায়। এরপর যদি তাদের কেবল নিম্নমানের বা উদ্বৃত্ত খাবার দেওয়া হয়, তবে এটি তাদের মনে 'কষ' (কষ্ট বা বঞ্চনার অনুভূতি) সৃষ্টি করে। তাদের আত্মসম্মান আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং নিয়োগকর্তার প্রতি আস্থায় চিড় ধরে। এই মানসিক কষ্ট দূর করা সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব। শ্রমে স্বীকৃতি: ভালো খাবার বা বিশেষ খাবার দেওয়া হলো তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্বীকৃতি। এর মাধ্যমে আপনি তাকে জানাচ্ছেন যে, আপনি তার কাজকে মূল্য দেন এবং মানুষ হিসেবে তাকে সম্মান করেন। এই সামান্য সম্মানটুকু তাদের মনে কর্মোদ্যম ও কাজের আন্তরিকতা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
গ. নৈতিক দিক: উদারতা ও মানবিক মূল্যবোধের পরীক্ষা নৈতিকতা হলো মানুষের প্রতি মানুষের সহজাত দায়িত্ববোধ। চুক্তির বাইরে গিয়েও যখন আমরা কাউকে কিছু দেই, তখন তা কেবল পারিশ্রমিক নয়, বরং তা আমাদের মানবিক মূল্যবোধের পরিচায়ক। উদারতা ও সৌজন্য: নৈতিকভাবে আমাদের উচিত কেবল চুক্তির জালে আবদ্ধ না থাকা। খাওয়া-পরা মানুষের মৌলিক চাহিদা। অতিথি আপ্যায়নের মতো গৃহকর্মীকেও সম্মানের সাথে খাওয়ানো উদারতার লক্ষণ। 'নষ্ট করে ফেলে না দিয়ে...': কেবল ফেলে দেওয়া বা নষ্ট হতে যাওয়া খাবার দেওয়া নৈতিকভাবে দুর্বলতা প্রকাশ করে। এমন আচরণে গৃহকর্মী নিজেকে দয়ার পাত্র বা করুণার বস্তুতে পরিণত বলে মনে করতে পারে। অন্যদিকে, সজ্ঞানে তার জন্য ভালো খাবার বরাদ্দ করা সহমর্মিতা ও উচ্চ নৈতিকতার পরিচয় বহন করে। একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের প্রতি এই সমানুভূতি প্রদর্শন করা আমাদের মৌলিক নৈতিক কর্তব্য।
৩. উপসংহার: মহৎ হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ প্রতিদান গৃহকর্মীকে 'খালা', 'চাচী' বা 'বেটি' বলে সম্বোধন করা কেবল একটি শব্দের ব্যবহার নয়, এটি একটি আহ্বান—যাতে আমরা তাদের পরিবারের অংশ হিসেবে দেখি। মাস শেষে পারিশ্রমিক পরিশোধ করা আমাদের আর্থিক চুক্তি; কিন্তু চুক্তির বাইরে গিয়েও তাকে আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করা এবং বিশেষ খাবার ভাগ করে নেওয়া আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধের চূড়ান্ত প্রমাণ। মনে রাখবেন, আপনি যা দেবেন, তা আপনার ভান্ডার থেকে কমবে না। বরং, সহানুভূতির সাথে দেওয়া এই সামান্য খাবারটুকু তার মনে যে শান্তি ও সম্মানবোধ এনে দেবে, তার বিনিময়ে আপনার গৃহকর্মীর কাজের আন্তরিকতা বাড়বে এবং আপনার প্রতি বিশ্বাস জন্মাবে। ফলস্বরূপ, আপনার পরিবার, গৃহে এবং সর্বোপরি আপনার আহারে আল্লাহ্ তা’আলা অফুরন্ত বরকত দান করবেন। তাদের প্রতি আপনার সৌজন্যমূলক আচরণই আপনার মহৎ হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ প্রতিদান।#
লেখক একজন শিক্ষক কবি গবেষক ও প্রাবন্ধিক
সম্পাদক ও প্রকাশক: মো: রোকনুজ্জামান রোকন নির্বাহী সম্পাদক: ইফতেখার আলম সম্পাদক কর্তৃক উত্তর নওদাপাড়া, পো: সপুরা, রাজশাহী-৬২০৩ থেকে প্রকাশিত। মোবাইল: ০১৭১১-২০৮ ১৭২, ০১৮৩৪-৮৬১ ০০৭ ইমেইল: dainiksobujnagar@gmail.com
Copyright © 2025 দৈনিক সবুজ নগর