ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম
ভূমিকা : ভারসাম্যপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থায় শালীনতার সীমারেখা - বাড়াবাড়ি বা কমতি নয়, কেবল নির্দেশিত পরিপালন ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় মানবজাতির শারীরিক ও আত্মিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কিছু মৌলিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নারী ও পুরুষের জন্য সতর (আবৃতব্য অংশ) ও পর্দা (আচ্ছাদনের বিধান)। এই বিধান কেবল শালীনতা ও নৈতিকতা রক্ষার জন্য নয়, বরং সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যও অপরিহার্য।
ইসলামের নির্দেশ হলো, ঠিক যতখানি আবৃত করার নির্দেশ, ততখানিই আবৃত করতে হবে—কমও নয়, বেশিও নয়। নির্দেশিত সীমার বাইরে গিয়ে বাড়াবাড়ি বা কমতি করা উভয়ই ইসলামে অনুমোদিত নয়। ইসলামের বিধানকে অহেতুক কঠিন করে তোলা বা উপেক্ষা করা, উভয়ই শরীয়তের মূল স্পিরিট বা লক্ষ্যের পরিপন্থী। মহান আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন, "আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান এবং কঠিন করতে চান না।" (সূরা আল-বাকারা, ২:১৮৫)। ফিকহের আলোকে সতর-এর সীমারেখা সতর হলো শরীরের সেই অংশ, যা আবৃত রাখা ফরয (বাধ্যতামূলক)। এই সীমা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যেমন—নামাজ, নির্জনে, বা ভিন্ন লিঙ্গের সামনে—ভিন্ন হতে পারে।
প্রধান চারটি মাযহাবের (হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী, হাম্বলী) ফকিহগণ এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ক. পুরুষের সতর: পুরুষের জন্য সতর হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। নামাজের সময় এবং গাইরে-মাহরাম (যার সাথে বিবাহ বৈধ) নারীর সামনে এই অংশ আবৃত রাখা বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, নাভি সতরের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে হাঁটু অবশ্যই সতরের অন্তর্ভুক্ত।
খ. নারীর সতর (নামাজ ও গাইরে-মাহরামের সামনে): নারীর সতর পুরুষের তুলনায় বিস্তৃত। এই ক্ষেত্রে ফিকহের মূলনীতি হলো—নামাজ এবং গাইরে-মাহরাম পুরুষের সামনে পুরো শরীর আবৃত রাখা ফরয। হানাফী মাযহাব অনুযায়ী, পুরো শরীর সতর, তবে মুখমণ্ডল, হাতের কব্জি পর্যন্ত এবং পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত উন্মুক্ত রাখা বৈধ। তবে ফিতনার (অশান্তি/অনিরাপত্তা) ভয় থাকলে মুখমণ্ডলও আবৃত করা উত্তম। অন্যান্য মাযহাবের মধ্যে হাম্বলী ও কিছু শাফেয়ী ফকিহগণ মনে করেন, ফিতনার আশঙ্কায় মুখমণ্ডলও সতরের অন্তর্ভুক্ত এবং গাইরে-মাহরামের সামনে পুরো শরীর আবৃত করা জরুরি।
সকল মাযহাবের মূলনীতি হলো—শরীরের আবৃতব্য অংশ এমন পোশাকে আবৃত করতে হবে যা শালীন ও ঢিলেঢালা, যা শরীরের গঠন ফুটিয়ে তোলে না এবং যা দৃষ্টিকটুভাবে আকর্ষণীয় নয়। মাহরাম ও গাইরে-মাহরামের ভেদাভেদ শরীয়তের এই বিধানের প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাহরাম (যার সাথে বিবাহ চিরতরে হারাম) এবং গাইরে-মাহরাম (যার সাথে বিবাহ বৈধ) সম্পর্কের পার্থক্য বোঝা জরুরি। মাহরামের সামনে: পিতা, ভাই, পুত্র, মামা, চাচা বা শ্বশুরের মতো মাহরাম সম্পর্কের ক্ষেত্রে, শরীরের যে অংশ সাধারণত সাংসারিক কাজের সময় উন্মুক্ত থাকে (যেমন মাথা, চুল, ঘাড়, বুক, হাত ও পায়ের পাতা) তা উন্মুক্ত রাখা বৈধ। গাইরে-মাহরামের সামনে: চাচাতো/মামাতো ভাই, দেবর, ভাসুর বা এলাকার অন্য পুরুষের মতো গাইরে-মাহরামের সামনে নারীকে উপরে বর্ণিত কঠোর সতর সীমার মধ্যে থাকতে হবে।
পর্দা শুধু পোশাক নয়: দৃষ্টি ও আচরণের বিধান পর্দা বা হিজাব শুধু পোশাকের বিধান নয়; এটি একটি সামাজিক এবং আচরণগত নীতিশাস্ত্র। এর পরিধি পোশাকের বাইরের বিষয়গুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
দৃষ্টির পর্দা: নারী-পুরুষ উভয়কেই একে অপরের দিকে আকর্ষণীয় দৃষ্টিতে তাকানো থেকে বিরত থাকা ফরয। আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে উভয়কেই দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন (সূরা নূর, ২৪:৩০-৩১)।
আচরণের পর্দা: আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে হাঁটা বা কথা বলা থেকে বিরত থাকা। নারীদেরকে গাইরে-মাহরামের সাথে কোমল স্বরে কথা না বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে পুরুষের মনে কোনো ফিতনার উদ্রেক না হয় (সূরা আহযাব, ৩৩:৩২)। উপসংহার ইসলামে সতর ও পর্দার বিধান মানব সমাজের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ। এটি উগ্রতা, অশ্লীলতা এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য তৈরি একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
ইসলামের এই বিধান পালনে বাড়াবাড়ি বা অতি-কমতি করা—উভয়ই শরীয়তের মূল স্পিরিটের বিরোধী। বরং, শরীয়তের নির্দেশিত ভারসাম্যপূর্ণ সীমা বজায় রেখে জীবনযাপন করাই মুমিনের কর্তব্য এবং সামাজিক স্থিতি রক্ষার জন্য অপরিহার্য।#
# লেখক একজন শিক্ষক কবি গবেষক ও প্রাবন্ধিক