... ড. মোঃ আমিনুল ইসলাম
ভূমিকা: আচরণের প্রতিফলন 'আপনা আচরি ধর্ম অন্যরে শেখাও' – এই প্রবাদটি মানব শিক্ষাদানের এক চিরন্তন ও অকাট্য সত্যকে তুলে ধরে। এটি শুধু একটি উপদেশ নয়, বরং আদর্শ প্রজন্ম গঠনের মূল দর্শন। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, মৌখিক নির্দেশনার চেয়েও বাবা-মা বা শিক্ষকের ব্যক্তিগত আচরণই হয়ে ওঠে তাদের শিক্ষার প্রধান পাঠ্যপুস্তক। আপনি আপনার সন্তানের মধ্যে যে গুণাবলি দেখতে চান, তা কেবল মুখস্থ বুলি বা কঠোর নির্দেশনায় আসবে না; বরং তা আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজে, প্রতি পদক্ষেপে তাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠতে হবে। কারণ, শিশুরা শোনে কম, কিন্তু পর্যবেক্ষণ করে বেশি—তারা দেখে শেখে।
এই নিবন্ধে আমরা দেখব কিভাবে এই দর্শন ধর্মীয়, সামাজিক, দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের জীবন ও শিক্ষাদানকে প্রভাবিত করে। প্রবন্ধের মূল অংশ: শিক্ষাদানের চার স্তম্ভ
১. ধর্মীয় ও নৈতিক দিক: আদর্শের বাস্তবায়ন প্রায় প্রতিটি ধর্মেই সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও মানবতাবাদী আচরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষাকে শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যক্তিগত জীবনে অনুশীলন করাই হলো এই প্রবাদের ধর্মীয় তাৎপর্য। উপমা ও উদাহরণ: ইসলাম ধর্মে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনকে 'উসওয়াতুন হাসানা' বা 'উত্তম আদর্শ' বলা হয়। তিনি যা প্রচার করতেন, তা নিজেই কঠোরভাবে পালন করতেন। যেমন, তিনি অন্যকে সততার শিক্ষা দেওয়ার আগে নিজের জীবনে সততার সর্বোচ্চ মান স্থাপন করেছিলেন। ঠিক তেমনি, হিন্দু ধর্মেও বিভিন্ন দেব-দেবীর আচরণকে মানবজীবনের পথপ্রদর্শক হিসেবে মানা হয়। একজন বাবা যখন তার সন্তানকে নামাজ/পূজা করতে বলেন, তার নিজের নিয়মিত উপাসনা সেই কথার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী শিক্ষা দেয়। শিক্ষণীয় গল্প: এক লোক তার ছেলেকে নিয়ে বুদ্ধের কাছে গেলেন। লোকটি বললেন, "প্রভু, আমার ছেলে খুব চিনি খায়। দয়া করে ওকে মিষ্টি খেতে বারণ করুন।" বুদ্ধ বললেন, "তুমি এক সপ্তাহ পরে এসো।" এক সপ্তাহ পর লোকটি এলে বুদ্ধ ছেলেটিকে চিনি খেতে বারণ করলেন। লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি তো গত সপ্তাহেই বারণ করতে পারতেন?" বুদ্ধ হেসে জবাব দিলেন, "গত সপ্তাহে আমি নিজেও অতিরিক্ত চিনি খাচ্ছিলাম। নিজে না ছেড়ে অন্যকে বারণ করলে তা মিথ্যা হয়ে যেত। এই এক সপ্তাহে আমি আগে নিজে মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছি।"
২. দার্শনিক দিক: আত্ম-শুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই প্রবাদটি আত্ম-শুদ্ধি এবং প্রজ্ঞার দিকে ইঙ্গিত করে। কোনো জ্ঞান বা মূল্যবোধ প্রচারের আগে নিজেকে সেই মূল্যবোধের ধারক হিসেবে গড়ে তোলা হলো প্রজ্ঞা। প্লেটোর দর্শন: প্লেটোর মতে, উত্তম জীবন কেবল ধারণা নয়, বরং অনুশীলনের বিষয়। একজন আদর্শ শিক্ষক বা অভিভাবক তখনই তার ছাত্র বা সন্তানকে নৈতিকতার পথে চালিত করতে পারেন, যখন তিনি নিজে সেই পথের পথিক। এটি হল সক্রিয় নীতিবিদ্যা (Active Ethics) যেখানে তত্ত্বের চেয়ে অনুশীলন মুখ্য। উপমা: একটি মোমবাতি যেমন নিজে না জ্বলে অন্যকে আলো দিতে পারে না, তেমনি একজন মানুষ নিজে সৎ না হলে অন্যকে সততার প্রকৃত অর্থ বোঝাতে পারে না। আপনার কথাটি হলো 'আলোর ধারণা', আর আপনার কাজটি হলো 'জ্বলন্ত মোমবাতি'। সন্তান জ্বলন্ত মোমবাতিকেই অনুসরণ করবে।
৩. মনস্তাত্ত্বিক দিক: মডেলিং এবং পর্যবেক্ষণমূলক শিক্ষা মনস্তত্ত্বের ভাষায়, এই শিক্ষণ পদ্ধতিকে 'মডেলিং' (Modeling) বা 'পর্যবেক্ষণমূলক শিক্ষা' (Observational Learning) বলা হয়। মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট বান্দুরা দেখিয়েছেন যে শিশুরা অন্যদের, বিশেষ করে তাদের আইডলদের (বাবা-মা) আচরণ নকল করে শেখে। পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণ: যখন কোনো বাবা-মা বাচ্চাকে বলেন, "রাগ করো না, শান্ত হও," কিন্তু নিজেরা সামান্য কারণে রেগে যান, তখন বাচ্চাটি শব্দগুলোর অর্থ নয়, বরং রাগের বহিঃপ্রকাশটিই শেখে। অন্যদিকে, বাবা-মা যখন কঠিন পরিস্থিতিতেও ধৈর্যের সাথে সমস্যা সমাধান করেন, তখন সন্তানের মস্তিষ্কে ধৈর্য ও সহনশীলতার ইতিবাচক মডেল তৈরি হয়। মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব: এই ধরনের শিক্ষাদান সন্তানের মনে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। তারা মনে করে, "বাবা-মা যদি এটি করতে পারেন, তবে আমিও পারব।" এটি কেবল নির্দেশ নয়, বরং প্রেরণা ও সক্ষমতার অনুভূতি জাগায়।
৪. সামাজিক দিক: বিশ্বাসযোগ্যতা ও সুনাগরিকতা সামাজিক ক্ষেত্রে, নেতার বা অভিভাবকের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে তার আচরণের ওপর। সমাজে পরিবর্তন আনতে হলে নেতাকে আগে সেই পরিবর্তনের প্রতীক হতে হয়। উপমা: সমাজের একজন প্রধান যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন, কিন্তু নিজেই গোপনে দুর্নীতি করেন, তখন তার কথা সমাজে কোনো প্রভাব ফেলে না, বরং তার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। কিন্তু যখন তিনি নিজের জীবনযাপনকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাখেন, তখন তার কথা সমাজের জন্য আইন হয়ে দাঁড়ায়। সুনাগরিক তৈরি: একজন বাবা যদি ট্রাফিক আইন মেনে চলেন, লাইনে দাঁড়িয়ে কাজ করেন এবং প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করেন, তবে সেই সন্তান স্বয়ংক্রিয়ভাবে একজন সুশৃঙ্খল ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।
উপসংহার: উত্তরাধিকারের পথ 'আপনস আচরি ধর্ম অন্যরে শেখাও' – এই প্রবাদটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, শিক্ষাদান হলো জীবনব্যাপী একটি প্রদর্শনী। আমাদের সন্তান বা শিক্ষার্থীরা আমাদের কথার প্রতিধ্বনি নয়, বরং আমাদের আচরণের প্রতিচ্ছবি। একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য নিজের ভেতরে সততা, দয়া, শৃঙ্খলা এবং নৈতিকতার যে বীজ বপন করা হয়, তারই ফলস্বরূপ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আরও উন্নত, মানবিক ও আলোকিত সমাজ গঠন করতে পারে। সুতরাং, আপনার সন্তানের ভবিষ্যত নির্মাণে সেরা বিনিয়োগ হলো—আজ আপনি নিজে কেমন আচরণ করছেন, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া। কারণ, আপনি যা দেখাবেন, তারাই তা শিখবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেই উত্তরাধিকারই পৌঁছে দেবে"!#
... লেখক পরিচিতি : লেখক একজন শিক্ষক কবি গবেষক ও প্রাবন্ধিক